২০১৯ সালে ইউইএফএ নেশন লিগে পর্তুগালের গুইমারিসে নেদারল্যান্ডস (Netherlands) ও ইংল্যান্ডের সেমিফাইনাল খেলার পূর্বে কমলা জার্সি পরা ডাচ ফুটবল দল ডাচ একাদশের (Het Nederlands elftal) ছবি বিভ্রান্তিকর দাবিতে ইউরো ২০২০ আবহে জিইয়ে উঠল।
২৮ জুন ২০২১ কোয়ার্টার ফাইনালের ম্যাচে চেক রিপাবলিকের প্যট্রিক শিক (Patrik Schick), টমাস হোলস (Tomas Holes) ২-০ গোলে হারায় নেদারল্যান্ডসকে। চেক রিপাবলিক শনিবার ৩ জুলাই সেমি ফাইনালে মুখোমুখি হবে ডেনমার্কের। ২০১২ সালের পর আবার কোয়ার্টার ফাইনালে জায়গা করে নিল চেক। ২০০৪ সালের পর থেকে এবারের ইউরোও হতাশ করল ডাচদের।
বুদাপেস্টের (Budapest) পুসকাস এরেনা (Puskás Aréna) স্টেডিয়ামে চলা ম্যাচে যোগ দিতে উন্মাদনায় ভাসা ডাচ ফুটবল প্রেমীদের ঢল নামে রাস্তায়। সেই দৃশ্যকে সম্পাদনা করে অন্য গান জুড়ে ভুয়ো দাবি সহ একটি ভিডিও ভাইরাল হয়েছিল। বুম সেই ভুয়ো খবরের তথ্য-যাচাই করেছে।
আরও পড়ুন: বিভ্রান্তিকর দাবিতে ছড়াল বুদাপেস্টে ডাচ ফুটবল ফ্যানদের উন্মাদনা দৃশ্য
ফেসবুকে ভাইরাল হওয়া ছবিটিতে কমলা জার্সি পরা নেদারল্যান্ডসের জাতীয় দলের ডিফেন্ডার ডেনজেল ডামফ্রাইস (Denzel Dumfries), হাল্কা সবুজ জার্সি পরা গোলগিকপার জাসপার সিলেসেন (Jasper Cillessen) সহ মোট এগারোজনকে দেখা যায়।
ফেসবুকে ভাইরাল হওয়া গ্রাফিক পোস্টটিতে কৌতুকের মোড়কে লেখা হয়েছে, "বাংলা, ভারত পেরিয়ে এবার নেদারল্যান্ডে গেরুয়া ঝড়"। ছবিটি ফেসবুকে পোস্ট করে ক্যাপশন লেখা হয়েছে, "বাংলা ভুল বুঝে গেরুয়াকে পরিত্যাগ করলেও গেরুয়া হারেনি। গৈরিক পতাকা ঊর্ধ্বে তুলে এগিয়ে এসেছে নেদারল্যান্ডস, ঋগ্বেদে যাকে উল্লেখ করা হয়েছে নৈঋতভূমি হিসেবে। জয়তে নেদারল্যান্ড। জয়তু হিন্দুরাষ্ট্র।"
ভারতের গৈরিক দল বিজেপির প্রভাব বলে কৌতুকাকারে এই ছবি পোস্ট করা হলেও নেটিজেনদের অনেকে বিষয়টিকে সত্যি ঘটনা বলে ভাবছেন।
এরকম দুটি ফেসবুক পোস্ট দেখা যাবে এখানে ও এখানে।
ফেসবুকে ব্যাপকভাবে ছবিটি একই ক্যপশন সহ শেয়ার করা হয়েছে।
আরও পড়ুন: না, এই ভিডিওটি নদীতে বাজ পড়ার দৃশ্য নয়
তথ্য যাচাই
হাঙ্গেরির বুদাপেস্টে উন্মাদনায় ভাসা ডাচ ফুটবল প্রেমীদের রাস্তায় ঢল নামলেও এই ছবিটি অবশ্য ইউরো ২০২০ খেলার সঙ্গে সম্পর্কিত নয়। নেদারল্যান্ডসের জাতীয় ফুটবল দলের কমলা জার্সির সঙ্গে হিন্দু ধর্ম, গেরুয়া রঙ ও ভারতের যোগ কাকতালীয়ভাবে ক্ষীণ।
বুম রিভার্স সার্চ করে ফুটবল ক্রীড়া বিষয়ক ওয়েবসাইট গোল-এর জাপানি সংস্করণে ৯ জুন ২০১৯ ছবিটি খুঁজে পায়। ওই ওয়েবসাইটে ছবিটিকে গেট্টি ইমেজেস-কে উৎস করা হয়েছে। ছবিটি ৬ জুন, ২০১৯ তারিখে পর্তুগালের গুইমারিসে ইংল্যান্ড ও নেদারল্যান্ডসের মধ্যে হওয়া ইউইএফএ সেমি-ফাইনাল ম্যাচ শুরুর আগে হয়েছিল। ইস্তাদিও দি আফোন্সো হেনরিকুইস ক্রীড়াঙ্গনে (Estadio D. Afonso Henriques,) ডিন মউথরোপোলাস ছবিটি তুলেছিলেন।
নেদারল্যান্ডস ও কমলা ইতিহাস
আমস্টারডামের রিজকস মিউজিয়ামের ওয়েবসাইট অনুযায়ী নেদারল্যান্ডসের কমলা রঙের ইতিহাস বেশ পুরনো। ডাচদের কমলা প্রীতির নেপথ্যে নায়ক হলেন নেদারল্যান্ডসের জাতির জনক উইলিয়াম অরেঞ্জ বা নীরব উইলিয়াম (William the Silent)। অরেঞ্জ-ন্যাসো বংশের প্রতিষ্ঠাতা প্রথম অরেঞ্জ হলেন তৃতীয় হেনরির পুত্র রঘনে অফ শালো (René of Chalon)। এর সঙ্গে আবার রয়েছে ফ্রান্সের যোগ। অরেঞ্জ-ন্যাসো বংশের সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ ব্যক্তিত্ব উইলিয়াম অরেঞ্জ হলেন তৃতীয় হেনরির পুত্র রঘনে অফ শালোর তুতো ভাই।
ষোড়শ শতাব্দীতে বংশপরম্পরায় স্পেনে শাসনভার পান রাজা দ্বিতীয় ফিলিপ। রাজা দ্বিতীয় ফিলিপ নেদারল্যান্ডসের সামরিক ও প্রাশাসনিক প্রধান উইলিয়াম অরেঞ্জের বিরুদ্ধে নানা বেনিয়মের অভিযোগ তেলেন। উইলিয়াম অরেঞ্জও রাজা দ্বিতীয় ফিলিপের বিরুদ্ধে পাল্টা অভিযোগ তোলেন। স্পেনের শাসন থেকে মুক্তিকামী উইলিয়াম অরেঞ্জ পরে ১০ জুলাই ১৫৮৪ সালে ক্যাথলিক উগ্রবাদীর হাতে গুপ্তহত্যার শিকার হন। ততদিনে রাজা দ্বিতীয় ফিলিপের একচ্ছত্র আধিপত্য কিছুটা কমেছে। এরপর নেদারল্যান্ডসে ৮০ বছর ধরে বিপ্লব চলে বৈদেশিক শক্তির সহযোগিতায়।
২০১৩ সালে প্রকাশিত ইএসপিএনের নেদারল্যান্ডসের ফুটবল ইতিহাস সংক্রান্ত এক প্রতিবেদনেও বলা হয়, খেলা শুরুর প্রথম থেকেই নেদারল্যান্ডসের জাতীয় দল অরেঞ্জ (Oranje) বা ডাচ একাদশ (Het Nederlands elftal) কমলার ব্যবহার করেছে। ১৯৩৪ সালে খেলা প্রথম বিশ্বকাপেও নেদারল্যান্ডসের ফুটবল খোলোয়াড়রা গাঢ় নীলের সাথে কমলা মোজা পরে খেলেছিল। ইউরো ২০২০-তে নেদারল্যান্ডসের খেলোয়াড়দের জার্সি প্রস্তুতকারক সংস্থা নাইকি কমলা রঙের ব্যবহারের কারণ হিসাবে সেদেশের রাজ পরিবারের গর্বের কথা উল্লেখ করেছে।
উইলিয়াম অরেঞ্জের প্রতি সম্মান জানিয়ে নেদারল্যান্ডসের ফুটবল ফ্যানরাও কমলা রঙ ব্যবহার করে রিপোর্টে জানায় ক্রীড়া বিষয়ক সংবাদমাধ্যম গোল। ২০১৯ সালে নেদারল্যান্ডসের রানী ম্যাক্সিমাও তাঁর ভারত সফরের পঞ্চম দিনে ডাচ রাজ পরিবারের ঐতিহ্য বজায় রেখে কমলা রঙের পোশাক পরেছিলেন।
আরও পড়ুন: ছোটবেলায় চুরি করতেন মোদী? বিভ্রান্তিকর দাবিতে ভাইরাল সম্পাদিত ভিডিও