রিজার্ভ ব্যাংক কি ব্যাঙ্ক-গ্রাহকদের অনুমতি দিয়েছে, কেওয়াইসি ফর্ম পূরণে জাতীয় জনগণনা পঞ্জির নথি সরবরাহ করতে? এবং এই নথি না দিতে পারলে কি আপনি ব্যাঙ্ক থেকে আপনার জমানো টাকা তুলতে পারবেন না? এমনই একটি দাবি কিন্তু হোয়াটসঅ্যাপ বার্তায় ভাইরাল হয়েছে। বার্তায় তেলুগু সংবাদপত্রে প্রকাশিত সেন্ট্রাল ব্যাঙ্ক অফ ইন্ডিয়ার একটি বিজ্ঞপ্তি উদ্ধৃত করা হচ্ছে এবং তার ছবিও দেওয়া হচ্ছে।
তবে বুম যাচাই করে দেখেছে, যদিও আরবিআই কেওয়াইসি-র অন্যতম নথি হিসাবে অন্যান্য নথির সঙ্গে জাতীয় জনগণনা পঞ্জির এই নথিও সরবরাহ করতে বলেছে, কিন্তু এই নথি কীভাবে হস্তগত করা যাবে, সে বিষয়ে কোনও ব্যাঙ্কই স্পষ্টভাবে কিছু জানে না। হোয়াটসঅ্যাপ বার্তাটির ক্যাপশন হলো: "সেন্ট্রাল ব্যাঙ্কে অফ ইন্ডিয়া একটি সরকারি বিজ্ঞপ্তিতে ঘোষণা করেছে, কেওয়াইসি-র তালিকায় তারা জাতীয় নাগরিকপঞ্জির নথিকেও অন্তর্ভুক্ত করেছে। এই নথি না দিতে পারলে ব্যাঙ্কে আমাদের আমানত স্থগিত হয়ে যাবে এবং আমরা টাকা তুলতেও পারব না। তাই এখনই এই সব অ্যাকাউন্ট থেকে টাকা তুলে নিন এবং সেন্ট্রাল ব্যাঙ্কের সব অ্যাকাউন্ট বাতিল করে দিন।"
বার্তাটি ব্যাঙ্ক পরিষেবার বিষয়ে গুরুতর গুজব সৃষ্টি করেছে, ২০১৯ সালের শেষের দিকে পাঞ্জাব অ্যান্ড মহারাষ্ট্র ব্যাঙ্কে (পিএমসি) সংকটের সময় যেমনটা হয়েছিল।
এ ব্যাপারে আমাদের পডকাস্টটি শোনা যাবে এখানে।
বুম অনেক বার এই হোয়াটসঅ্যাপ বার্তাটি তার হেল্পলাইন নম্বরে (৭৭০০৯০৬১১১) পেয়েছে, যার নমুনা নীচে দেওয়া হল।
এনাডু টাইমস সংবাদপত্রে তেলুগু ভাষায় দেওয়া সেন্ট্রাল ব্যাঙ্ক অফ ইন্ডিয়ার বিজ্ঞাপনটি এখানে দেখতে পারেন। (১১ জানুয়ারি পত্রিকার তেলেঙ্গানা ও বৃহত্তর হায়দরাবাদ সংস্করণে এটি প্রকাশিত হয় ৩য় পৃষ্ঠায়)
তবে সোশাল মিডিয়ায় তোলা এই দাবিটি ভুয়ো, কারণ প্রথমত নথিটি জাতীয় নাগরিকপঞ্জির (এনআরসি) নয়, জাতীয় জনগণনা পঞ্জির (এনপিআর)-এর—এবং সেটিও কেওয়াইসির জন্য জরুরি একমাত্র নথি নয়, অনেক নথির অন্যতম।
এই ভুলটিকে বাদ দিলে বুম অন্য আরও কিছু বীমা কোম্পানি ও ব্যাঙ্কের ক্ষেত্রেও এনপিআর থেকে সংগৃহীত নথি কেওয়াইসিতে গ্রাহ্য হবে বলে জেনেছে। এগুলি হল
কিন্তু এই নথিটা কী এবং আমরা কীভাবে এটা সংগ্রহ করব
বুম তিনটি ব্যাঙ্কের সঙ্গে এ নিয়ে কথা বলেছে যে, এটা কী ধরনের নথি এবং কী ভাবে গ্রাহকরা এটা সংগ্রহ করতে পারেন। কোনও ব্যাঙ্কই বুম-এর এই প্রশ্নের কোনও সদুত্তর দিতে পারেনি। তবে প্রতিটি ব্যাঙ্কই জানিয়েছে, রিজার্ভ ব্যাঙ্কের নির্দেশিকা অনুযায়ী এটা কেওয়াইসি ফর্মের সঙ্গে দেওয়ার অনেক রকম বিকল্প নথির মধ্যে একটি, একমাত্র নথি নয়।
সেন্ট্রাল ব্যাঙ্কের এক উচ্চপদস্থ আধিকারিক বুমকে জানান: "আমরা নিজে থেকে এই বিজ্ঞপ্তি জারি করিনি। এটা আমাদের নিজস্ব সিদ্ধান্তও নয়। এটা রিজার্ভ ব্যাঙ্কের কেওয়াইসি ভরার নির্দেশিকায় অন্যান্য যে সব নথির কথা বলা হয়েছে, সেই আধার কার্ড, প্যান কার্ড, ভোটার পরিচয়পত্র ইত্যাদির মতোই একটি নথি হিসাবে জমা দেওয়ার কথা বলা হয়েছে।" ব্যাঙ্কের টোল-ফ্রি কাস্টমার কেয়ার নম্বরে জানতে চাইলেও তারা ব্যাঙ্কের কোনও শাখা থেকে বিশদে বিষয়টা জেনে নিতে অনুরোধ করেছে।
বুম কোটাক মহিন্দ্র ব্যাঙ্কের দক্ষিণ মুম্বই শাখাতেও এ ব্যাপারে খোঁজখবর নেয়। সেই ব্যাঙ্কের এক মহিলা কর্মচারী চারপাশে ছড়িয়ে থাকা এক গাদা আবেদনপত্রের মধ্যে বসে বলেন: "ওটা কেওয়াইসি ফর্ম পূরণ করতে যে সব নথি লাগে, সেই আধার, প্যান, ভোটার আইডি কিংবা ড্রাইভিং লাইসেন্সের মতোই একটি নথি। তবে আমরা এনপিআর-এর নথির ব্যাপারে এখনও কিছু জানি না। জানলে পরে আপনাদের জানাতে পারব।"
আমরা এইচডিএফসি-র কাস্টমার কেয়ারেও খোঁজ করি। সেখান থেকে বলা হয়, কেওয়াইসি ফর্ম ভরতে আধার, প্যান বা পাসপোর্ট, যে কোনও একটা নথি থাকলেই চলবে।
তাহলে কেওয়াইসির জন্য এনপিআরের নথির ব্যাপারে আমরা কী জানতে পারলাম?
এটুকুই যে, রিজার্ভ ব্যাংকের নির্দেশিকা অনুসারেই এনপিআর থেকে প্রাপ্ত নথিকে কেওয়াইসি ফর্ম ভরার অন্যতম নথি হিসাবে গ্রাহ্য করা হবে। সেই নির্দেশিকা অনুযায়ী এনপিআরের নথিটা সরকারিভাবে বৈধ আরও অন্যান্য নথি যথা, ভোটার পরিচয়পত্র, প্যান, আধার, ড্রাইভিং লাইসেন্স বা জাতীয় গ্রামীণ কর্মসংস্থান নিশ্চয়তা প্রকল্পে (এনরেগা) পাওয়া কার্ড-এর মতোই গ্রহণযোগ্য হবে।
তবে কেওয়াইসির জন্য এনপিআর-এর নথির আবশ্যকতা কোনও সাম্প্রতিক সংযোজন নয়। ২০১৫ সালে যখন অর্থমন্ত্রক অর্থ পাচার নিরোধ আইন সংশোধন করে, তখনই রিজার্ভ ব্যাঙ্কের সঙ্গে পরামর্শক্রমে এনপিআরের নথির বিষয়টি কেওয়াইসি ফর্মের সঙ্গে যুক্ত করা হয়। এ সংক্রান্ত বিজ্ঞপ্তিটি এখানে দেখুন।
শুধু তাই নয়, ২০১১ সালের জনগণনার সময়েও গণনাকারীরা বাড়ি-বাড়ি গিয়ে স্লিপ বিলি করেন, গণনা প্রক্রিয়া সম্পূর্ণ করতে যেগুলি এনপিআর শিবিরে নিয়ে জমা দেওয়ার কথা। এনপিআর কর্তৃপক্ষ সেটা তাদের ফ্রিকোয়েন্টলিআস্কড কোয়েশ্চেন বা প্রায়শ জ্ঞাতব্য জিজ্ঞাসার তালিকায় অন্তর্ভুক্তও করেছে।
এনপিআর একটি গণনা প্রক্রিয়া, যা নাগরিকত্ব-নির্বিশেষে ভারতে বসবাসকারী ব্যক্তিদের পঞ্জি বা তালিকা তৈরি করে। ২০১০-১১ সালে করা সেই গণনার তথ্য-পরিসংখ্যান ২০১৫ সালে হালনাগাদ করা হয় এবং ২০২০ সালে, আর তিন মাসের মধ্যেই আবার নতুন করে শুরু হবেl এই প্রক্রিয়ার বিরোধী যারা, যেমন পশ্চিমবঙ্গ ও কেরল, তাদের আশঙ্কা, এই প্রক্রিয়া থেকে প্রাপ্ত তথ্য জাতীয় নাগরিকপঞ্জিতে চালানো হবে।