ভারতীয় শিক্ষা ব্যবস্থার সংস্কারের জন্য কেন্দ্রীয় শিক্ষা মন্ত্রক প্রণীত জাতীয় শিক্ষানীতি অনেক গুরুতর প্রশ্নেরই কোনও সদুত্তর দিতে পারেনি। যেমন কবে থেকে এই নীতি কার্যকর করা হবে, পঞ্চম শ্রেণি পর্যন্ত শিক্ষার মাধ্যম কী ভাবে, কবে পাল্টানো হবে, এবং পঠন-পাঠন, পরীক্ষা-গ্রহণ বা ভর্তির প্রক্রিয়াই বা কেমন করে বদলানো হবে!
গতকালই কেন্দ্রীয় মন্ত্রিসভা এই নয়া শিক্ষানীতি অনুমোদন করেছে, যা গত চৌত্রিশ বছরে প্রথম শিক্ষা নীতির পরিবর্তন। এর লক্ষ্য হলো শিক্ষায় মুখস্থবিদ্যার ভূমিকা কমিয়ে দেওয়া, সিলেবাসকে আরও নমনীয় করা, যাতে কোনও বাঁধা-ধরা গত্ মেনে শিক্ষার্থীদের চলতে না হয়।
সরকার জানিয়েছে, ২০৩০-৪০-এর মধ্যে এই নীতির পরিবর্তিত লক্ষ্যগুলি পূরণ করে ফেলতে চায়। কিন্তু কিছু খুঁটিনাটি প্রশ্ন তবু থেকেই যাচ্ছে।
১) আমার স্কুলে কি শিক্ষার মাধ্যম বদলে যাবে?
নয়া শিক্ষা নীতি পঠন-পাঠনের মাধ্যম হিসাবে মাতৃভাষা বা আঞ্চলিক ও স্থানীয় ভাষাকে ধার্য করেছে। "যেখানেই সম্ভব, অন্তত পঞ্চম শ্রেণি পর্যন্ত বা তারও পরে অষ্টম শ্রেণি পর্যন্ত, এমনকী তার পরেও শিক্ষার মাধ্যম হিসাবে মাতৃভাষা কিংবা এলাকার আঞ্চলিক বা স্থানীয় ভাষাকে অগ্রাধিকার দিতে হবে l তার পরেও স্থানীয় ভাষাকে যেখানেই সম্ভব অন্যতম ভাষা হিসাবে পাঠ্যসূচির অন্তর্ভুক্ত করতে হবে, সরকারি এবং বেসরকারি উভয় ধরনের স্কুলেই l"
এ জন্য অত্যন্ত উচ্চ মানের পাঠ্যপুস্তক স্থানীয় ভাষায় রচনা করতে হবে, যেখানে তা সম্ভব নয়, সেখানে দ্বিভাষিক পাঠ্য রচনা করতে হবে।
শিক্ষা সংবিধান অনুসারে যৌথ তালিকাভুক্ত, স্কুলগুলিও একদিকে যেমন কেন্দ্রীয় বোর্ড সিবিএসই এবং আইসিএসসি-র অধীন, তেমনই রাজ্যে রাজ্যে বিভিন্ন প্রাদেশিক মধ্য শিক্ষা পর্ষদের অধীন। কেন্দ্র ও রাজ্য উভয় সরকারই স্কুলগুলিকে আর্থিক সহায়তাও দিয়ে থাকে।
যদিও নীতিনির্দেশে সরকারি ও বেসরকারি উভয় ধরনের স্কুলেই মাতৃভাষার মাধ্যমে শিক্ষাদানের কথা বলা হয়েছে, তবু এগুলি সরকারি সাহায্যপ্রাপ্ত স্কুল এবং সাহায্য-বর্জিত স্কুলের ক্ষেত্রে কেমন করে সমানভাবে প্রযোজ্য হয়, তা দেখার। আঞ্চলিক বা স্থানীয় ভাষায় লেখা পাঠ্যবই এবং তা পড়ানোর মতো অভিজ্ঞ শিক্ষক কেমন করে ব্যবস্থা করা হবে, সেটাও একটা প্রশ্ন।
২) আগামী বছর থেকে কি আমার পরীক্ষা আরও সহজ হয়ে উঠবে?
মুখস্থবিদ্যার উপর নির্ভরশীলতা কমাতে নয়া শিক্ষা নীতিতে বোর্ড পরীক্ষার গুরুত্ব কমানোর ওপর জোর দেওয়া হয়েছে। সেই সঙ্গে টিউশন এবং শিক্ষার বাণিজ্যিকীকরণ কমাতে শিক্ষণীয় বিষয়ের মূল ধারণাগুলিকে কেবল পাঠ্যসূচির অন্তর্গত করার প্রস্তাব দেওয়া হয়েছে। কেউ যদি নিয়মিত স্কুলে যায়, তাহলে তার পক্ষে পরীক্ষায় কৃতকার্য হওয়া কোনও কঠিন ব্যাপার হবে না। তা ছাড়া, নিজেদের পরীক্ষার ফল আরও ভাল করতে শিক্ষার্থীরা দু বার পরীক্ষায় বসার সুযোগ পাবে।
কোভিড-১৯ অতিমারীর ফলে গোটা শিক্ষার প্রক্রিয়াটাই বিশ বাঁও জলের তলায় চলে যাওয়ায় এই সব নয়া নীতি কবে কী ভাবে কার্য়কর করা যাবে, তা নিয়েও সংশয় রয়েছে। সরকারের অবশ্য আশা, পুরো নীতিটা কার্যকর হতে হতে ২০৩০-৪০ সাল হয়ে যাবে।
৩) আমার এম-ফিল ডিগ্রির কী হবে?
উচ্চশিক্ষাকে আরও যৌক্তিক রূপ দেওয়ার জন্য নয়া শিক্ষানীতির প্রস্তাবগুলি হল,
- ৩ বছরের ডিগ্রি কোর্স চালুর প্রস্তাব দেওয়া হয়েছে, যার পরে ২ বছরের স্নাতকোত্তর কোর্স থাকবে
- ৪ বছরের স্নাতক কোর্স, যার শেষ বছরটি গবেষণার জন্য ধার্য এবং তারপর ১ বছরের স্নাতকোত্তর কোর্স
- স্নাতক ও স্নাতকোত্তর মিলিয়ে মোট ৫ বছরের একটিই সুসংহত কোর্স
পিএইচ ডি-র প্রথম ধাপ হিসাবে এম-ফিল বা মাস্টার্স অফ ফিলজফি কোর্সটি বাতিল করা হয়েছে। নয়া নীতির সুপারিশ অনুযায়ী স্নাতকোত্তরের পরেই বা এমনকী ৪ বছরের স্নাতক কোর্স করার পরেই সরাসরি পিএইচডি করা যাবে। এখন যারা এম-ফিল ডিগ্রি ধারী, তাঁদের ক্ষেত্রে পিএইচডি করার ক্ষেত্রে কী করণীয়, সে ব্যাপারটা নয়া নীতিতে স্পষ্ট করা নেই।
৪) বিভিন্ন স্ট্রিম থেকে মিলিয়ে-মিশিয়ে বিষয় বাছলে পড়াশোনার ওপর তার প্রভাব কী হবে
নয়া নীতিতে বিজ্ঞান, কলা ও বাণিজ্য বিভাগের ব্যবধান-রেখা ঘুচিয়ে দেবার প্রস্তাব রয়েছে। যেমন একজন বিজ্ঞান বিভাগের ছাত্র অতঃপর স্কুলে এবং কলেজেও সাহিত্য, সঙ্গীত ইত্যাদি বিষয়কে পাঠ্য হিসাবে বেছে নিতে পারবে। কিন্তু এই ব্যাপারটা চালু করার মতো পরিকাঠামো এবং শিক্ষক কী করে পাওয়া যাবে, সেটা মোটেই স্পষ্ট নয়।
৫) সরকার কি শিক্ষা খাতে ব্যয়-বরাদ্দ বাড়াবে?
সরকারের লক্ষ্য শিক্ষা খাতে ব্যয় দেশের মোট জাতীয় উত্পাদনের ৬ শতাংশে তুলে আনা, এখন যার পরিমাণ সাড়ে ৪ শতাংশl কেন্দ্র ও রাজ্য মিলিয়ে যাবতীয় সরকারি ব্যয়ের ১০ শতাংশ আগামী দশ বছর শিক্ষার জন্য ব্যয় করার কথাও বলা হয়েছে।
বেসরকারি উচ্চ শিক্ষার ক্ষেত্রেও বর্ধমান খরচের সমস্যাটি বৃত্তি দান ইত্যাদি মারফত সরকার মীমাংসা করতে চায়। "আর্থিক অপারগতার কারণে কোনও শিক্ষার্থী যেন উ্চ শিক্ষার সুযোগ থেকে বঞ্চিত না হয় l জাতীয় মেধা-বৃত্তির কাঠামোটি এমন ভাবে সম্প্রসারিত করা হবে যাতে উচ্চশিক্ষার কোনও প্রতিষ্ঠানে ভর্তি হওয়ার ক্ষেত্রে মেধাবী ছাত্রদের অর্থাভাবে ভুগতে না হয় l বেসরকারি উচ্চশিক্ষার প্রতিষ্ঠানগুলিকেও শিক্ষার্থীদের জন্য ১০০ শতাংশ থেকে অন্তত ২৫ শতাংশ পর্যন্ত বৃত্তির ব্যবস্থা রাখতে হবে l"
৬) শিক্ষকদের যোগ্যতামানে কী ধরনের পরিবর্তন চাওয়া হচ্ছে
২০৩০ সাল নাগাদ শিক্ষক হওয়ার জন্য ন্যূনতম যোগ্যতা লাগবে ৪ বছরের বি-এড কোর্স পাশ করা। যাঁরা কোনও বিশেষ স্ট্রিমে স্নাতক হয়েছেন, তাঁদের ২ বছরের বি-এড হলেই চলবে। আর যারা ৪ বছরের স্নাতক ডিগ্রি বা স্নাতকোত্তর ডিগ্রি অর্জন করেছেন, তাঁদের জন্য এক বছরের বি-এড কোর্স থাকবে। এই ডিগ্রিগুলো ৪ বছরের বি-এড কোর্স পড়ানোর প্রতিষ্ঠানেই পড়া যাবে।
নয়া শিক্ষানীতির বয়ানের খসড়া দেখুন
এখানেl