বিহারের বিধানসভা নির্বাচন, নীতীশ কুমারের নেতৃত্বে ন্যাশনাল ডেমোক্র্যাটিক অ্যালায়েন্স-এর (এনডিএ) সামনে দুটো লক্ষ্য স্থির করে দিয়েছিল। এক, একটি রেকর্ড স্থাপন করা। দুই, যে কোনও দলের পক্ষে, তিনটি পূর্ণ মেয়াদ ক্ষমতায় থাকার পর চতুর্থ বারের জন্য ফিরতে না-পারার যে ধারা অব্যাহত ছিল, সেটিকে ভাঙ্গা।
বিহারে নির্বাচন হয় এমন এক সময়ে যখন অতিমারি চলছে। এবং তার নেতিবাচক প্রভাব বিহারের বহু মানুষকে এক কঠিন পরিস্থিতির মধ্যে ফেলে দিয়েছে। বিশেষ করে মার্চ মাসে, দেশব্যাপী লকডাউন শুরু হওয়ার প্রথম কয়েক সপ্তাহে, বিহারের মানুষকে চরম ভোগান্তির শিকার হতে হয়।
তাছাড়া, বেকারত্বের মতো পাহাড়প্রমাণ সমস্যা তো ছিলই। কিন্তু অর্থনীতির সঙ্কোচনের ফলে, তা আরও বিরাট আকার ধারণ করে।
কিন্তু এই সব চ্যালেঞ্জগুলিকে অতিক্রম করে, বিহারে এনডিএ এক নির্বাচনী রেকর্ড স্থাপন করেছে, যদিও আসনের ব্যবধান খুবই সামান্য।
বিহার কী রাজনৈতিক বার্তা দিল?
বিহারের নির্বাচনে কয়েকটি বিষয় প্রথমবার লক্ষ্য করা গেল। সেগুলি হল:
১) কয়েক দশক পর, এই প্রথম, নীতীশ কুমারের জনতা দল ইউনাইটেড সে রাজ্যের বিধান সভায় দু'টি প্রধান দলের তালিকায় আর থাকছে না। আর লোক জনশক্তি পার্টির ভরাডুবি হয়েছে এই ভোটে।
২) আসদউদ্দিন ওয়াইসির এআইএমআইএম মুসলমান অধ্যুষিত বিহারের 'সীমাঞ্চল' এলাকায় পাঁচটি সিট জিতে, নাটকীয়ভাবে সে্ রাজ্যের রাজনীতিতে প্রবেশ করেছে।
৩) ২০১৯ লোকসভা নির্বাচনে ধরাশায়ী হলেও, এই বিধানসভা নির্বাচনে, রাষ্ট্রীয় জনতা দল অনেটা জমি ফিরে পেয়েছে। যদিও সীমাঞ্চল ও কোশির মতো তাদের ঘাঁটিগুলিতে তারা তেমন ভাল ফল করতে পারেনি।
৪) সিপিআই, সিপিআই(এম) ও সিপিআই(এমএল) – এই তিনটি বাম পার্টি সবচেয়ে ভাল হারে জিতেছে। এবং ভবিষ্যতে কি হতে পারে, এটা কি তারই একটা ইঙ্গিত?
এবার দেখা যাক, বিহারের নির্বাচনী ফলাফল সারা দেশকে কি বার্তা দিচ্ছে।
১) জাতপাতের রাজনীতি বদল সামাজিক ন্যায়ের রাজনীতিতে
বিহার অন্য সব জায়গার তুলনায় আরজেডি দু'টি জায়গায় ভাল ফল করেছে – ভোজপুর ও পাটালিপুত্র। সাম্প্রতিক নির্বাচলগুলিতে, এই দুটি জায়গাই আরজেডির ক্ষেত্রে বেশ দুর্বল প্রমাণিত হচ্ছিল। রাজ্যের গড় হিসেবের তুলনায়, এই দুই অঞ্চলে শহরবাসীর সংখ্যা বেশি। এই জায়গাগুলি অন্য এলাকার তুলনায় সম্পন্ন। এবং সাম্প্রতিক বছরগুলিতে এখানে তীব্র জাতি সংঘর্ষ ঘটেছে।
এই অঞ্চলে বামপন্থী পার্টি সিপিআই(এমএল)-এর যথেষ্ট প্রভাব আছে। তারা সমাজের নিপীড়িত গোষ্ঠীগুলির প্রতিনিধিত্ব করে। অতীতে, আরজেডি ও সিপিআই(এমএল)-এর সম্পর্ক বেশ তিক্ত ছিল। এবার নিজেদের মধ্যে জোট স্থাপন করে তারা সামাজিক ও অর্থনৈতিকভাবে পিছিয়ে-থাকা সম্প্রদায়গুলির একটি সামাজিক জোট তৈরি করেন।
এই সামাজিক জোট নির্বাচনে ভাল ফল করে। এর থেকে সর্বশক্তিমান এনডিএ-র বিরোধীরা কি কোনও বার্তা পেয়েছেন?
২) মহিলা ফ্যাক্টর
২০০৫-এর নির্বাচনে, মহিলা ভোটদাতাদের স্ংখ্যা ছিল ৪৩ শতাংশ। ২০১৫-এ তা বেড়ে হয় ৬০ শতাংশ। নীতীশ কুমারের শাসনকালে, বিধানসভা নির্বাচনে মহিলাদের অংশগ্রহণ লাফিয়ে লাফিয়ে বেড়েছে। এবারেও পুরুষদের তুলনায়, মহিলাদের অংশগ্রহণ ছিল ৪ শতাংশ বেশি। এবং একাধিক সমীক্ষায় দেখা গেছে যে, বিগত কয়েক বছরে, নীতীশ ও তাঁর জোটসঙ্গীরা তাঁদের প্রতিপক্ষের তুলনায় মহিলাদের ভোট বেশি পেয়েছেন।
গত ১৫ বছরে, নীতীশ কুমারের বেশ কিছু গুরুত্বপূর্ণ প্রকল্পের মূলে রয়েছে মহিলাদের উন্নতি সাধনের চেষ্টা। বিহারই হল ভারতের প্রথম রাজ্য যেখানে পঞ্চায়েতগুলিতে ৫০ শতাংশ আসন মহিলাদের জন্য সংরক্ষিত করা হয়। নীতীশ কুমারের তত্ত্বাবধানেই সে কাজ হয়। স্কুলের ছাত্রীদের সাইকেল দেওয়ার ফলে, মেয়েদের স্কুলছুটের সংখ্যা উল্লেখযোগ্যভাবে কমে যায়। এও বলা হয় যে, মহিলাদের খুশি করার জন্য, নীতীশ বিহারে মদ নিষিদ্ধ করার মত ঝুঁকিপূর্ণ পদক্ষেপ নেন। পর্যবেক্ষকরা মনে করছেন যে, মহিলা ভোটাররাই নীতীশ কুমারকে ৪ র্থ দফার জন্য ক্ষমতায় ফিরিয়ে এনেছেন।যা অবশ্যই একটি রেকর্ড।
৩) অর্থনৈতিক দুর্দশা কি কোনও প্রভাব ফেলে? এবং বেকারত্ব সম্পর্কে যে আলোচনা হয়েছে, তা কি মানুষকে নাড়া দিয়েছে?
নির্বাচনের আগে থেকেই, ভারতের অর্থনীতিতে বড় আকারের সঙ্কোচন দেখা দেয়। বিহারের ওপর তার প্রভাব অতি মাত্রায় পড়ে। অন্যান্য রাজ্যের তুলনায়, এখানে বেকারত্বের হার অনেক বেশি বেড়ে যায়। এই বিষয়গুলি কি নির্বাচনের ওপর কোনও প্রভাব ফেলেছে? সম্ভবত সেই কারণেই, গত লোকসভা নির্বাচনের তুলনায় এবার, এনডিএর ভোটের হার ১৪ শতাংশ কমে যায়। কিন্তু যেহেতু এনডিএ বিভিন্ন সামাজিক গোষ্ঠীগুলিকে নিয়ে এক শক্তিশালী জোট গড়ে তুলতে পেরেছে, তাই ভোটের শতাংশ কমে যাওয়া সত্ত্বেও, এই নির্বাচনে জিতেছে তারা।
নীতীশ কুমারের প্রতি দলিতদের একটা বড় অংশের সমর্থন রয়েছে। 'মহাদলিত' বলে উনি একটি গোষ্ঠী সৃষ্টি করে তাঁদের নানান সুবিধে পাওয়ার ব্যবস্থা করে দিয়েছেন। এছাড়াও 'এমবিসি' নামের আরও একটি গোষ্ঠী তৈরি করেন তিনি। পিছিয়ে থাকা গোষ্ঠীগুলির মধ্যে যাঁরা আরও পিছিয়ে থাকা তাঁরাই ওই গোষ্ঠীর অন্তর্ভুক্ত। একত্রে, এই দুই গোষ্ঠীর জনসংখ্যা রাজ্যের প্রায় ৪০ শতাংশ। অন্যদিকে, ভারতীয় জনতা পার্টির রয়েছে সমাজের সুবিধেভোগী সম্প্রদায়গুলির জনসমর্থন। ফলে, দুয়ে মিলে, এনডিএ বিহারে এক অতি শক্তিশালী সামাজিক জোটবন্ধন গড়ে তুলেছে।
দীর্ঘ দিন ধরে গড়ে-তোলা ও লালিত এই সামাজিক জোটবন্ধন এনডিএ-কে এই নির্বাচনে সামান্য ব্যবধানে হলেও, জিতিয়ে দিয়েছে।
৪) এলজেপি-র হার এআইএমআইএম-র সাফল্যে পুষিয়ে দিয়েছে
এই নির্বাচনে লোক শক্তি পার্টির একটাই লক্ষ্য ছিল – নীতীশ কুমার ও তাঁর পার্টিকে আঘাত করা। বিশ্বস্ত সূত্র থেকে জানা গেছে যে, অন্তত ২২টি কেন্দ্রে এলজেপি জিডিইউ-র জেতার সম্ভাবনাকে বানচাল করে দেয়। পর্যবেক্ষকরা বলছেন, এলজেপি-র কারণেই এবার জেডিইউ-র আসন সংখ্যা বিজেপি ও আরজেডি-র থেকে কম।
কিন্তু এনডিএ-র পক্ষে যা কাজ করল তা হল এআইএমআইএম-বিএসপি-র সাফল্য। ওই পার্টি, আরজেডি ও কংগ্রেসের ঘাঁটি বলে পরিচিত অঞ্চলে ৭ টি আসন জিতে নেয়। আরজেডির সমর্থক বলে পরিচিত সীমাঞ্চলে, জনসংখ্যার প্রায় ৪০ শতাংশ হলেন মুসলমান ও যাদব। কিন্তু সেখানে এআইএমআইএম জিতে নেয় ৫ টি আসন। যৌথভাবে, আরজেডি ও কংগ্রেসের আসন সংখ্যা সেখানে ১০ ছুঁতে পারেনি।
৫) আসরে নতুন প্রজন্ম
তেজস্বী যাদব ও চিরাগ পাসওয়ান-এর মত নেতাদের জন্য এই নির্বাচন বিশেষ তাৎপর্যপূর্ণ ছিল। গুরুত্বপূর্ণ ঐতিহ্য বহন করে নিয়ে যাওয়ার দায়িত্ব ছিল তাঁদের দু'জনের ওপর। এলজেপি-র চিরাগ পাসওয়ান একা লড়ার ঝুঁকি নিলেন। কিন্তু ফলাফল বেরনর সঙ্গে সঙ্গে দেখা গেল যে, নিজের পার্টির শক্তি সম্পর্কে তাঁর অনুমান ভুল ছিল। অন্যদিকে, নিজের পার্টির ফলাফল সম্পর্কে তেজস্বীর আত্মতুষ্টির যথেষ্ট কারণ আছে।
জয়ের খুব কাছে এসেও, তীরে তরী ভেড়াতে না পারার ফলে তিনি অসন্তুষ্ট বোধ করতেই পারেন। কিন্তু ১৮ মাস আগে, লোকসভা নির্বাচনে ভরাডুবির পর, তাঁর পার্টি যে আবার ঘুরে দাঁড়িয়েছে, তার জন্য অবশ্যই কৃতিত্ব দবি করতে পারেন তেজস্বী।
আরও পড়ুন: গিরিরাজ সিংহ বিহারে মুখ্যমন্ত্রী হোক, প্রধানমন্ত্রী মোদীর চিঠিটি ভুয়ো