পাঁচটি সংস্থার গবেষণায় উঠে এসেছে যে ভারতের অর্থনীতির সঙ্কোচনের পরিমাণ চলতি ২০২১ অর্থবর্ষে ৯% থেকে ১৪.৮% পর্যন্ত হতে পারে।
এই সংস্থাগুলির মধ্যে রয়েছে ক্রিসিল, গোল্ডম্যান স্যাক্স, ফিচ, স্টেট ব্যাঙ্ক অব ইন্ডিয়ার রিসার্চ ডেস্ক এবং ইন্ডিয়া রেটিংস। কয়েক মাস আগে জিডিপি সংক্রান্ত যে পূর্বাভাস তারা করেছিল, তার চেয়ে পরিস্থিতি আরও খারাপ হতে পারে বলেই তারা এখন মনে করছে।
আগে এই সংস্থাগুলি অনুমান করেছিল, ভারতের জিডিপি হ্রাস পাবে বটে, কিন্তু সেই সঙ্কোচনের হার দশ শতাংশের কম হবে। কিন্তু এখন সংস্থাগুলির অনুমান, সঙ্কোচনের হার ছাড়িয়ে যেতে পারে দশ শতাংশের গণ্ডিকেও।
মে মাসে বুম তার প্রতিবেদনে জানয়েছিল, কী ভাবে এইসব সংস্থাগুলি অনুমান করছে যে ভারত চতুর্থমন্দার মুখে পড়তে চলেছে।
বর্তমান অর্থবর্ষের প্রথম তিন মাসে গত অর্থবর্ষের একই সময়কালের তুলনায় মোট অভ্যন্তরীণ উৎপাদনের পরিমাণ ২৩.৯ শতাংশ কম হওয়ার পরই এই গবেষণা সংস্থাগুলি ভারত সম্বন্ধে পূর্বাভাস সংশোধন করছে। ভারতে কোভিড-১৯'এর বিরুদ্ধে লড়ার জন্য যে দেশব্যাপী লকডাউন করা হয়েছিল, তার ধাক্কাতেই অর্থব্যবস্থা ধরাশায়ী হয়েছে বলে অনুমান করা হচ্ছে।
গবেষণা সংস্থাগুলির পূর্বাভাস ঠিক বলছে, দেখা যাক। এখন অবধি সবচেয়ে নেতিবাচক পূর্বাভাস পাওয়া যাচ্ছে এইচএসবিসির দেওয়া পরিসংখ্যানে, যাতে বলা হয়েছে যে অর্থনীতির সঙ্কোচনের পরিমাণ ৭.২% পর্যন্ত হতে পারে, এবং গোল্ডম্যান সাক্স-এর অনুমান, যাতে জানানো হয়েছে যে বর্তমান অর্থবর্ষে এই পতনের পরিমাণ হতে পারে ১১.৮% পর্যন্ত। আন্তর্জাতিক অর্থ ভান্ডারের অনুমান অনুসারে ভারতের অর্থনীতির সঙ্কোচনের হার হতে পারে ৪.৫% পর্যন্ত। এখনও অবধি যত পূর্বাভাস পাওয়া গিয়েছে, তার মধ্যে অর্থ ভান্ডারেরটিই সবচেয়ে কম ভীতিপ্রদ।
সরকারের পক্ষ থেকে দুটি নীতি নির্ধারক সংস্থা জানিয়েছে এই আর্থিক বর্ষে ভারত ঋণাত্মক বৃদ্ধির মুখোমুখি হবে। তবে, জিডিপির পরিমাণ কতখানি কমবে, সেই বিষয়ে তারা কোনও নির্দিষ্ট অনুমান করেনি। ২২ মে রিজার্ভ ব্যাঙ্ক অব ইন্ডিয়ার গভর্নর শক্তিকান্ত দাস বলেন যে এই অর্থবর্ষে ভারতের বৃদ্ধির হার থাকবে শূন্যের নীচে। ২৭ আগস্ট জিএসটি কাউন্সিলের বৈঠকে অর্থমন্ত্রী নির্মলা সীতারামন জানান যে, ভারতীয় অর্থনীতির আয়তন হ্রাস পেতে চলেছে এবং তার কারণ হিসাবে তিনি ভগবানের লীলার উল্লেখ করেন।
এই পতন ঠেকাতে সরকার 'আত্মনির্ভর ভারত অভিযান' নামে একটি প্যাকেজ নিয়ে এসছে। যদিও সব মিলিয়ে এর মূল্য ২১ লক্ষ কোটি (অর্থাৎ জিডিপির ১০%), কিন্তু হিসেব কষে দেখা যাচ্ছে, প্রকৃত প্রস্তাবে সরকার খরচ করছে ঘোষিত প্যাকেজের মাত্র দশ শতাংশ।
এই সব পরিসংখ্যান সম্পর্কে আপনার যা জানা দরকার
১. গোল্ডম্যান স্যাক্স
গোল্ডম্যান স্যাক্স তাদের একটি গবেষণা নথিতে ২০২০ সাল এবং ২০২১-অর্থবর্ষ (এপ্রিল ২০২০-মার্চ ২০২১), উভয় সময়কালের জন্যই ভারতের আর্থিক বৃ্দ্ধির হারের ক্ষেত্রে তাদের পূর্বাভাসে কাটছাঁট করেছে।
গোল্ডম্যান স্যাক্স আগে জানিয়েছিল, ২০২১-অর্থবর্ষে ভারতীয় অর্থনীতি ১১.৮ শতাংশ সঙ্কুচিত হবে। এখন তাদের অনুমান, এই সঙ্কোচনের পরিমাণ ১৪.৮ শতাংশ হবে। জানুয়ারি-ডিসেম্বর ২০২০, এই সময়কালে সঙ্কোচনের পরিমাণ দাঁড়াবে ১১.১ শতাংশ। আগে এই অনুমানটি ছিল ৯.৬ শতাংশ।
২. ফিচ
এ মাসে প্রকাশিত তাদের গ্লোবাল ইকোনমিক আউটলুকে ফিচ জানিয়েছে ভারতের চলতি আর্থিক বর্ষে অর্থনীতির সঙ্কোচন হতে পারে ১০.৫%। মে মাসে তাদের অনুমান ছিল ৫%। সেখান থেকে পূর্বাভাস আরও ৫.৫% কমে গেছে। কোভিড-১৯ রোগীর সংখ্যা বাড়তে থাকায় প্রথম অর্ধে জিডিপির পতন যা ভাবা হয়েছিল, তার থেকে অনেক বেশি নীচে নেমে গেছে।
তারা জানিয়েছে, "জিডিপির সংকোচনের হার ২৪% -- আমরা জুনে জিইওতে যা অনুমান করেছিলাম তার দ্বিগুণ পতন হয়েছে। বিশ্বে সমস্ত দেশে কঠোর লকডাউন ছিল সে সময়।" তারা আরও জানিয়েছে পরবর্তী আর্থিক বর্ষে ভারতের বৃদ্ধির হার হতে পারে ১১% এবং ২০২২ সালের প্রথম অর্ধের আগে কোভিডের পূর্ববর্তী অবস্থায় ফিরতে পারবে না।
তাদের রিপোর্ট দেখতে পারেন এখানে।
৩. ক্রিসিল
'মাইনাস নাইন নাউ' নামে প্রতিবেদনে ক্রিসিল জানিয়েছে এই অর্থবর্ষে ভারতের জিডিপি ৯% পর্যন্ত হ্রাস পেতে পারে। ক্রিসিল একটি ক্রেডিট রেটিং এজেন্সি। মে মাসে তারা একটি প্রতিবেদনে (ঘটনাচক্রে ওই প্রতিবেদনের শিরোনাম ছিল মাইনাস ফাইভ) ৫% পতনের সম্ভাবনা জানিয়েছিল, সেখান থেকে সংখ্যাটা আরোও নেমে গেছে।
কোভিড-১৯ এই পতনের কারণ বলে মনে করা হচ্ছে। ভারতে কোভিড-১৯ রোগীর সংখ্যা বাড়ছে এবং সরকার যথাযথ অর্থনৈতিক সহযোগ দিতে পারছে না। তামিলনাড়ু, মহারাষ্ট্র কর্নাটক এবং অন্ধ্রপ্রদেশের মতো রাজ্য যেখান থেকে ভারতের জিডিপির এক তৃতীয়াংশ আসে, সেখানে কোভিড-১৯ আক্রান্তের সংখ্যা খুব বেশি। তবে ভাল বৃষ্টি হওয়ার ফলে কৃষিক্ষেত্র ২.৫% বৃদ্ধির সম্ভাবনা রয়েছে।
ক্রিসিল অনুমান করছে, মাঝারি মেয়াদে ভারতের জিডিপির ১৩% ক্ষতি হতে পারে। আগামী ত্রৈমাসিকের ক্ষেত্রে সঙ্কোচনের হার ১২% পর্যন্ত নেমে যেতে পারে। ক্রিসিলের একটি প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, "অতিমারির আগের জিডিপির হারে পৌঁছতে গেলে আসল জিডিপির হার পরবর্তী তিনটি অর্থবর্ষে বার্ষিক ১৩% বৃদ্ধি হওয়া দরকার, অতীতে কোনও দিন যে হারে ভারতীয় অর্থনীতির বৃদ্ধি ঘটেনি।"
ক্রিসিলের প্রতিবেদন দেখতে পারেন এখানে।
৪. এসবিআই রিসার্চ
দ্য স্টেট ব্যাঙ্ক অব ইন্ডিয়ার রিসার্চ ডেস্ক অনুমান করছে এখন ভারতের অর্থনৈতিক সঙ্কোচন ১০.৯% পর্যন্ত হতে পারে। তাদের আগের অনুমান ছিল ৬.৮%।
এসবিআই রিসার্চ আরও জানিয়েছে পরবর্তী তিনটি ত্রৈমাসিকে বৃদ্ধির হার হবে যথাক্রমে— -১২% থেকে -১৫%, -৫% থেকে -১০% এবং -২% থেকে -৫%।
আর্থিক সঙ্কোচনের হার ১০.৯ শতাংশ হবে, এই অনুমানের ভিত্তিতে এসবিআই রিসার্চের অমুমান, এই অর্থবর্ষে কেন্দ্রীয় সরকারের রাজকোষ ঘাটতির পরিমাণ দাঁড়াবে জিডিপি-র ৯.৩ শতাংশ, টাকার অঙ্কে সতেরো লক্ষ ত্রিশ হাজার কোটি টাকা।
এসবিআই'র 'ইকোনর্যাপ' প্রতিবেদনের প্রয়োজনীয় অংশ দেখতে পারেন এখানে।
৫. ইন্ডিয়া রেটিংস অ্যান্ড রিসার্চ
ইন্ডিয়া রেটিংস অ্যান্ড রিসার্চ অনুমান করছে ২০২১ অর্থবর্ষে অর্থনৈতিক বৃদ্ধির হার সংকুচিত হয়ে ১১.৮% হয়ে যেতে পারে যা তারা আগে অনুমান করেছিল ৫.৩%।
তারা জানিয়েছে, "সারা বিশ্ব যেখানে দ্বিতীয় দফার সংক্রমণের মুখোমুখি, সেখানে ভারত এখন পর্যন্ত প্রথম দফার সংক্রমণের হারই কমাতে পারেনি।"
ক্রিসিলের মতো তারা জানাচ্ছে কৃষিক্ষেত্র ভাল ফল করতে পারে, সেখানে বৃদ্ধির হার ৩.৫% হতে পারে। কেন্দ্র সরকারের আর্থিক ঘাটতির পরিমাণ ১৫.১৭ লাখ কোটি টাকা হতে পারে বলে মনে করা হচ্ছে।
এ বিষয়ে পড়তে পারেন এখানে।
ক্রিসিলের মুখ্য অর্থনীতিবিদ ডি কে জোশীর সঙ্গে কথা বললেন বুমের গোবিন্দরাজ এথিরাজ।
আরও পড়ুন: দিল্লি দাঙ্গা: উমর খালিদের ১০ দিনের পুলিশি হেফাজত