ব্যাঙ্কিং রেগুলেশন অ্যাক্ট-এর ৩৫ ও ৪৫ নম্বর ধারার বলে ওই সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়। ওই ধারা আরবিআইকে কিছু বিশেষ ক্ষমতা দিয়েছে। ওই ক্ষমতার জোরে, আরবিআই যে কোনও ব্যাঙ্কের বোর্ডকে অগ্রাহ্য করতে পরে, সবরকম ঋণ, বিনিয়োগ এবং টাকা তোলা বন্ধ করে দিতে পারে, প্রয়োজনীয় সব সিদ্ধান্ত নিতে পারে বা সঙ্কটাপন্ন ব্যাঙ্কটিকে অন্য ব্যাঙ্কের সঙ্গে সংযুক্ত করা বা সেটির পুনর্গঠনের পরিকল্পনা তৈরি করতে পারে। জনসাধারণের বা ব্যাঙ্কের আমানতকারীদের অথবা সামগ্রিক ব্যাঙ্কিং ব্যবস্থার স্বার্থে আরবিআই ওই ধরনের পদক্ষেপ নিয়ে থাকে। একটি ব্যাঙ্ক যদি আর্থিক সঙ্কটে পড়ে বা অব্যবস্থার শিকার হয়, তা হলে আরবিআই সেটির স্বাস্থ্য ফেরানর জন্য এই পদক্ষেপগুলি নিতে পারে। যাতে সেটি নতুন করে মূলধন পাওয়ার বা সংযুক্তিকরণের বা ম্যানেজমেন্ট পরিবর্তনের উপযুক্ত হয়ে ওঠে।
লক্ষী বিলাসকে নিয়ে, আরবিআই বিগত ১৪ মাসে তিনটি ব্যাঙ্কের ওপর এই রকম স্থগিতাদেশ আরোপ করল। এর আগে সেপ্টেম্বর ২০১৯ ও মার্চ ২০২০ তে আরবিআই দুর্নীতি ও মূলধন ঘাটতির কারণে পঞ্জাব অ্যান্ড মহারাষ্ট্র কোঅপারেটিভ ব্যাঙ্ক (পিএমসি ব্যাঙ্ক) ও ইয়েস ব্যাঙ্কের ওপর স্থগিতাদেশ আরোপ করে।
"আমরা দেখেছি যে, ইয়েস ব্যাঙ্কের পুনর্গঠন বা পিএমসির পথে বসা বা এলভিবি, কোনওটার বেহাল অবস্থার জন্য বাইরের কোনও কারণ দায়ী ছিল না। সবই মানুষের তৈরি কারণ ছিল। সেগুলি সবই সৃষ্টি করেছিলেন ব্যাঙ্কের ম্যানেজমেন্ট ও উদ্যোগ্তারা। তাঁরা নিয়ম কানুন উপেক্ষা করেন। যেমন ভাবে চালানো উচিৎ, তাঁরা ব্যাঙ্কগুলিকে সেভাবে চালাননি," বুমের গোবিন্দরাজ এথিরাজকে এই কথা বলেন ব্যাঙ্ক বিশেষজ্ঞ ও সাংবাদিক তমাল বন্দ্যোপাধ্যায়।
এই তিনটি বাদে, বাকি আটটি ব্যাঙ্ককে বেসরকারি বা রাষ্ট্রায়ত্ত ব্যাঙ্কের সঙ্গে যুক্ত করে দেওয়া হয়েছে। সম্ভবত লক্ষী বিলাস ব্যাঙ্কও ওই একই দিকে এগোচ্ছে। আরবিআই ইতিমধ্যেই সেটিকে ডিবিএস ব্যাঙ্কের সঙ্গে একীকরণ করার একটি খসড়া পরিকল্পনা রচনা করেছে। স্থগিতাদেশের সঙ্গে একীকরণের খসড়া পরিকল্পনা তৈরি করাকে সুনজরেই দেখছেন বিশেষজ্ঞরা। ওই পদক্ষেপকে অনুমোদন
করছে বলেই জানিয়েছে রেটিং সংস্থাগুলি।
পিএসসি ব্যাঙ্ক এখনও স্বাভাবিক হয়ে ওঠেনি। ইয়েস ব্যাঙ্ককে চাঙ্গা করতে, স্টেট ব্যাঙ্ক অফ ইন্ডিয়ার নেতৃত্বে বিভিন্ন ব্যাঙ্কের একটি কনসরটিয়াম সেটিকে মূলধন যোগানর ব্যবস্থা করেছে। বাকি ৮টি ব্যাঙ্কের অবস্থাটা দেখে নেওয়া যাক।
সিকিম ব্যাঙ্ক লিমিটেড (১৯৯৯)
মার্চ ১৯৯৯ তে, আরবিআই সিকিম ব্যাঙ্ক লিমিটেড-এর কার্যকলাপের ওপর স্থগিতাদেশ আরোপ করে। অব্যবস্থা ও যথেচ্ছ ভাবে ঋণ দেওয়ার ফলে, সেটির ৬৩.৭ কোটি টাকার আমানত ভিত্তি ধসে যায়। ২২ ডিসেম্বর, সেটিকে ইউনিয়ন ব্যাঙ্ক অফ ইন্ডিয়ার সঙ্গে মিশিয়ে দেওয়া হয়।
বেরিলি করপোরেশন ব্যাঙ্ক (১৯৯৯)
মার্চ ১৯৯৯ তে, বেরিলি করপোরেশন ব্যাঙ্ক-এর ওপরও স্থগিতাদেশ আরোপ করা হয়্। ৩ জুন ১৯৯৯ তে, সেটিকে ব্যাঙ্ক অফ বরোদার সঙ্গে মিশিয়ে দেওয়া হয়।
বেনারস স্টেট ব্যাঙ্ক (২০০২)
জানুয়ারি ২০০২-এ, আরবিআই ওই ব্যাঙ্কের ওপর বিধিনিষেধ আরোপ করে। প্রথমে, টাকা তোলার ক্ষেত্রে ১,০০০ টাকার সীমা বেঁধে দেওয়া হয়। পরে তা বাড়িয়ে ২,৫০০ করা হয়। সেটি ছিল একটি বেসরকারি ব্যাঙ্ক। বেনারসের সাবেক মহারাজার উদ্যোগে প্রতিষ্ঠিত হয়েছিল সেটি। ২০ জুন ২০০২ তে, সেটি ব্যাঙ্ক অফ বরোদার সঙ্গে মিশে যায়।
নেডুঙ্গাডি ব্যাঙ্ক (২০০৩)
কেরলের নেডুঙ্গাডি ব্যাঙ্ক শেয়ারের দামের আর্বিট্রেজ সংক্রান্ত নিময় লঙ্ঘন করেছিল। ফলে, নভেম্বর ২০০২ তে, সেটির কার্যকলাপের ওপর স্থগিতাদেশ আরোপ করে আরবিআই। ১ ফেব্রুয়ারি ২০০৩-এ সেটিকে পঞ্জাব ন্যাশনাল ব্যাঙ্কের সঙ্গে মিশিয়ে দেওয়া হয়।
গ্লোবাল ট্রাস্ট ব্যাঙ্ক (২০০৪)
২৪ জুলাই, ২০০৪-এ, বেসরকারি গ্লোবাল ট্রাস্ট ব্যাঙ্কের কাজের ওপর স্থগিতাদেশ জারি করে আরবিআই। কারণ, ওই ব্যাঙ্কের অনুৎপাদক সম্পত্তির পরিমাণ প্রায় ১,৫০০ কোটি টাকা হয়ে গিয়েছিল। তবে, স্থগিতাদেশ ঘোষণা করার ৪৮ ঘন্টার মধ্যে, ২৬ জুলাই, ওই ব্যাঙ্কটিকে ওরিয়েন্টাল ব্যাঙ্ক অফ কমার্সের সঙ্গে যুক্ত করা হয়। পরে ওরিয়েন্টাল ব্যাঙ্ক অফ কমার্স আবার পঞ্জাব ন্যাশনাল ব্যাঙ্কের সঙ্গে মিশে যায়।
সা্উথ গুজরাট লোকাল এরিয়া ব্যাঙ্ক (২০০৪)
নানান ধরনের জালিয়াতির শিকার হয় ব্যাঙ্কটি। ফলে, ১৩ নভেম্বর ২০০৩ তে, সেটির কাজ বন্ধ করে দেয় আরবিআই। সেটিকে ২৫ জুন ২০০৪-এ, ব্যাঙ্ক অফ বরোদার সঙ্গে যুক্ত করে দেওয়া হয়। কেন্দ্রীয় সরকার এই ব্যাঙ্কটি চালু করেছিল। উদ্দেশ্য ছিল স্থানীয় ব্যাঙ্কের বিকাশে সাহায্য করা। কিন্তু সে লক্ষ্য পূরণ হয়নি।
সাউথ ইন্ডিয়া কোঅপরেটিভ ব্যাঙ্ক (২০০৪)
৯ অগস্ট, ২০০৪-এ আরবিআই এই ব্যাঙ্কটির কাজের ওপর
বিধিনিষেধ আরোপ করে। ব্যাঙ্কটির সদর দপ্তর ছিল মাদুরাইতে। প্রায় ৪ বছর ধরে টানাপোড়েনের পর, ২০০৮-এ ব্যাঙ্কটিকে সারস্বত ব্যাঙ্কের সঙ্গে যুক্ত করা হয়। কিন্তু যাঁরা ওই ব্যাঙ্কে এক লাখ টাকার বেশি রেখেছিলেন, তাঁরা সব টাকা ফেরত পাননি।
গনেশ ব্যাঙ্ক অফ কুরুন্ডওয়াড (২০০৬)
মূলধন কমে যাওয়ায়, ৭ জানুয়ারি ব্যাঙ্কটির ওপর বিধিনিষেধ আরোপ করে আরবিআই। আর দুদিন পরে, ৯ জানুয়ারি, সেটিকে কেরলের ফেডারেল ব্যাঙ্কের সঙ্গে যুক্ত করে দেওয়ার একটি
খসড়া পরিকল্পনা তৈরি করে রিজার্ভ ব্যাঙ্ক। সংযুক্তিকরণ সেপ্টেম্বরে সম্পূর্ণ হয়।
ইউনাইটেড ওয়েস্টার্ন ব্যাঙ্ক (২০০৬)
এই ব্যাঙ্কের ওপর স্থগিতাদেশ ও তার সংযুক্তিকরণের মধ্যে ১০ দিনের ব্যবধান ছিল। ২ সেপ্টেম্বর সেটির কাজ বন্ধ করে দেওয়া হয়, আর ১২ সেপ্টেম্বর সেটিকে ইন্ডাস্ট্রিয়াল ডেভেলপমেন্ট ব্যাঙ্ক অফ ইন্ডিয়া-র (আইডিবিআই) সঙ্গে সেটিকে জুড়ে দেওয়া হয়। ১৭ টি ব্যাঙ্ক সেটিকে নিতে চেয়েছিল। কিন্তু শেষমেশ আইডিবিআই-ই সফল হয়।
এ বছর ৬ মার্চ, অর্থমন্ত্রী নির্মলা সীতারামন ইয়েস ব্যাঙ্কের ওপর বিধিনিষেধ আরোপ করার সিন্ধান্তের পক্ষে সওয়াল করতে গিয়ে, ওই সংযুক্তিকরণের বিষয়টি উত্থাপন করেন। উনি বলেন, আগের ইউপিএ সরকার সঠিক ভাবে ওই সংযুক্তিকরণ করতে না পারার ফলে, আইডিবিআই আর্থিক সঙ্কটের মধ্যে পড়ে। "আজকে আইডিবিআই-এর স্বাস্থ্য ফেরাতে আমার অসুবিধে হচ্ছে। এই উদাহরণ দিয়ে আমি বোঝাতে চাই কীভাবে স্বনিযুক্ত ডাক্তারেরা ডাব্লিউইউবি আর আইডিবিআই-এ সংযুক্তিকরণটা করেছিলেন,"
বলেন অর্থমন্ত্রী।
লর্ড কৃষ্ণ ব্যাঙ্ক ও ভারত ওভারসিজ ব্যাঙ্কের মতো কিছু সংস্থা আরবিআই-এর স্থগিতাদেশ আসার আগেই মিশে যেতে সক্ষম হয়। ২০০৭ -এ সেগুলিকে সেঞ্চুরিয়ন ব্যাঙ্ক অফ পঞ্জাব (যেটি পরে এইচডিএফসি-র সঙ্গে মিশে যায়) ও ইন্ডিয়ান ওভারসিজ ব্যাঙ্কের সঙ্গে জুড়ে দেওয়া হয়।
তমাল বন্দ্যোপাধ্যায়ের সঙ্গে বুমের ইন্টারভিউ নীচে দেখুন।