ভাইরাল হওয়া একটি হোয়াটসঅ্যাপ বার্তায় দাবি করা হয়েছে যে, যে কোনও জিনিসের ওপর ভাইরাসটি ১২ ঘন্টা বাঁচে। তাই ২২ মার্চের ১৪ ঘন্টার কার্ফিউ ভাইরাসটির ছড়িয়ে পড়ার সম্ভাবনা বন্ধ করে দেবে। কিন্তু দাবিটি বিভ্রান্তিকর। কোনও বৈজ্ঞানিক গবেষণায় এর সমর্থন মেলেনি।
বার্তাটি মূলত হোয়াটসঅ্যাপে ভাইরাল হয়েছে। প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদী বৃহস্পতিবার করোনাভাইরাস সংক্রান্ত এক ভাষণ দেন টেলিভিশনে। সেখানে উনি ২২ মার্চ ২০২০-র সকাল ৭-টা থেকে রাত ৯ টা পর্যন্ত 'জনতা কার্ফিউ' পালন করে দেশবাসীকে বাড়ি থেকে না বেরনর আবেদন করেন। তার ২৪ ঘন্টা পরেই বার্তাটি হোয়াটসঅ্যাপে ছড়াতে থাকে।
তাতে বলা হয়, "কোনও একটি বস্তুর ওপর করোনাভাইরাস ১২ ঘন্টা বাঁচতে পারে। আর কার্ফিউটা হল ১৪ ঘন্টার। ফলে, যে সব জায়গায় করোনাভাইরাস থাকতে পারে, সেখানে কারওর হাত পড়বে না ১৪ ঘন্টা। তাই সংক্রমণের ধারায় ছেদ পড়বে। ১৪ ঘন্টা পরে আমরা যা পাব তা হল একটি নিরাপদ দেশ।"
বুমের অনেক পাঠক বার্তাটির সত্যতা যাচাই করার অনুরোধ করেন।
বার্তাটি বিভ্রান্তিকর, কারণ:
এই বার্তাতে বলা হয়েছে ভাইরাসটি ১২ ঘন্টা বাঁচে। একটি গবেষণায় দেখা গেছে এই নতুন করোনাভাইরাস বাতাসে বেশ কয়েক ঘন্টা বাঁচতে পারে। এবং কিছু কিছু বস্তুর ওপর ২–৩ দিনও বেঁচে থাকে।
তাছাড়া, আরও কিছু জিনিস, যেমন বস্তুর ধরন, তাপমাত্র ও পরিবেশের আর্দ্রতার পরিমাণও ভাইরাসের জীবনকাল নির্ধারণ করে।
বার্তাটিতে আরও একটা বিষয় বিবেচনা করা হয়নি। তা হল, কার্ফিউ এর শেষে, কোনও আক্রান্ত ব্যক্তি যদি সনাক্ত না হয়ে থাকেন, তাহলে তিনি সংক্রমণ ছড়াতেই থাকবেন, যদি না তিনি সামাজিক দূরত্ব বজায় রাখেন।
বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা কি বলছে:
ভাইরাসটি কোনও এক বস্তুর ওপর কতক্ষণ বাঁচতে পারে—বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা এই প্রশ্নের উত্তর দিয়েছে। সেটি নীচে দেওয়া হল।
"যে ভাইরাসটি কোভিড-১৯-এর সংক্রমণ ঘটায়, কোন বস্তুর ওপর সেটি কতক্ষণ বাঁচে তা নিশ্চিত করে এখনও বলা যাচ্ছে না। কোভিড-১৯ ভাইরাস সম্পর্কে প্রাথমিক অনুসন্ধান এবং সাধারণভাবে করোনাভাইরাসের ওপর গবেষণা থেকে জানা গেছে যে ভাইরাসটি কোনও কোনও বস্তুর ওপর কয়েক ঘন্টা থেকে কয়েকদিন পর্যন্ত বেঁচে থাকতে পারে। অনেকগুলি কারণের ওপর নির্ভর করে সেটা (যেমন, কি ধরনের বস্তু, তাপমাত্র ও পরিবেশে আর্দ্রতার পরিমাণ।" বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা (দেখার জন্য ক্লিক করুন এখানে।)
বিশেষ শব্দ
গবেষণায় কী বলা হয়েছে তা বুঝতে হলে গবেষণায় ব্যবহৃত কিছু বিশেষ শব্দের মানে জেনে নেওয়া প্রয়োজন।
করোনাভাইরাস: এটি হল একটি ভাইরাস পরিবার। তার মধ্যে আছে সেই সব ভাইরাস যেগুলি সর্দি-কাশির কারণ। আবার আছে যারা খুব বেশি শ্বাস কষ্টের কারণ, যেমস 'সিভিয়ার অ্যাকিউট রেসপিরেটারি সিন্ড্রোম' (এসএআরএস-সারস) ভাইরাস। আর আছে, সেই ভাইরাস যেটি 'মিডিল ইস্ট রেসপিরেটারি সিন্ড্রোম' (এমইআরএস-মেরস) বলে এক অসুখ ঘটায়।
কোভিড-১৯: করোনাভাইরাস ডিজিজ ২০১৯
এসএআরএস-কোভ-২: যে ভাইরাস কোভিড-২ ঘটায়। পুরো নাম, 'সিভিয়ার অ্যাকিউট রেসপিরেটারি সিন্ড্রোম করোনাভাইরাস-২'।
২০১৯-এ এক নতুন করোনাভাইরাস চিহ্নিত করা হয়, যেটি চিনের উহানে এক ধরনের অসুখ ছড়ায়।
গবেষণা কী বলছে
এটা জেনে রাখা খুবই জরুরি যে, নতুন করোনাভাইরাস এমন একটা অসুখের কারণ, যেটা এখনও ছড়াচ্ছে এবং তা সম্পর্কে নতুন নতুন জিনিস জানা যাচ্ছে। যে ভাইরাসটি কোভিড-১৯ রোগের কারণ, সেটি কোন কোন বস্তুর ওপর কতক্ষণ বাঁচে, সে সম্পর্কে কিছু প্রাথমিক গবেষণা হয়েছে। কিন্তু সেগুলির 'পিয়ার রিভিউ' করা হয়নি বা সমগোত্রীয় গবেষকরা সেগুলি পর্যালোচনা করে দেখেননি এখনও।
গবেষণায় দেখা গেছে, ভাইরাসটি বাতাসে কয়েক ঘন্টা বেঁচে থাকে। এবং কিছু কিছু বস্তুর ওপর ২–৩ দিনও বাঁচতে পারে। একজন আক্রান্ত ব্যক্তি কাশলে কি হতে পারে, তা দেখার জন্য নেবুলাইজার ব্যবহার করেন গবেষকরা।
তাঁরা দেখেন, বাতাসে ভাইরাসটিকে তিন ঘন্টা পর্যন্ত বেঁচে থাকতে দেখা যায়। তামার ওপর চার ঘন্টা পর্যন্ত। কার্ডবোর্ডের ওপর বাঁচে ২৪ ঘন্টা। আর প্লাস্টিক ও স্টেনলেস স্টিলের ওপর দু' থেকে তিন দিন।।
গবেষণার ফলাফল জানাচ্ছে যে, ভাইরাসটি বাতাসে ভর করে ছড়াতে পারে। তাছাড়া, যেকোনও সংক্রমিত বস্তু স্পর্শ করার মাধ্যমেও সেটি ছড়ায়। আর ব্যক্তি থেকে ব্যক্তিতে সংক্রমণ তো হয়েই থাকে।
এই গবেষণাটি করে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের ন্যাশনাল ইনস্টিটিউট অফ হেলথ, প্রিন্সটন ইউনিভারসিটি এবং ইউনিভারসিটি অফ ক্যালিফরনিয়া, লস আঞ্জেলিস। তার জন্য অর্থ যোগায় মার্কিন সরকার ও ন্যাশনাল সায়েন্স ফাউন্ডেশন।
গবেষণাটি এখনও পিয়ার রিভিউ করা হয়নি। সেটি 'নিউইংল্যান্ড জার্নালঅফ মেডিসিন'-এ ১৭ মার্চ ২০২০ তে প্রকাশিত হয়। (আরও পড়ুন এখানে)
আরও একটি গবেষনায় সারস, মেরস, ও এন্ডেমিক হিউম্যান করোনাভাইরাসেস (এইচসিওভি) নিয়ে আগের সব গবেষণার ফলাফল বিশ্লেষণ করে দেখা গেছে যে, ওই ভাইরাসগুলি ধাতু, কাঁচ ও প্লাস্টিকের ওপর নয় দিন পর্যন্ত বাঁচতে পারে। ফেব্রুয়ারি ২০২০ তে 'হসপিটাল ইনফেকশন' জার্নালে স্টাডিটি প্রকাশিত হয়।
গবেষকরা এটাও বলেন যে, সাধারণ জীবাণুনাশক দিয়ে ভাইরাসটিকে মারা যায় এবং তাপমাত্রা বাড়ার সঙ্গে সঙ্গে সেটি লোপ পায়।
"কোনও বস্তুকে ০.১% সোডিয়ামহাইপোক্লোরাইড বা ৬২ই৭১% ইথানল দিয়ে সংক্রমণমুক্ত করলে, এক মিনিটের মধ্যে করোনাভাইরাসের সংক্রমণ ঘটানর ক্ষমতা উল্লেখযোগ্য ভাবে কমে যায়।"
এসএআরএস-সিওভ-২ এই স্টাডির অন্তর্ভুক্ত ছিল না।