রিজার্ভ ব্যাঙ্ক বড় অঙ্কের টাকা তোলার উপর নিয়ন্ত্রণ আরোপ করার পর থেকেই প্রায় প্রতিদিনই মুম্বইয়ের পাঞ্জাব অ্যান্ড মহারাষ্ট্র কো-অপারেটিভ ব্যাঙ্ক (পিএমসি ব্যাঙ্ক) সংবাদের শিরোনাম হচ্ছে। রিজার্ভ ব্যাঙ্ককে লেখা ব্যাঙ্কের ম্যানেজিং ডিরেক্টর জয় টমাসের পাঁচ পৃষ্ঠার একটি চিঠিও গণমাধ্যম ও সোশাল মিডিয়ায় পৌঁছে গিয়েছে, যাতে তারা সব নিয়মকানুন অগ্রাহ্য করে রিজার্ভ ব্যাঙ্ক সম্পূর্ণ অন্ধকারে রেখে একটি রিয়েল এস্টেট সংস্থাকে নিয়মিত বিপুল অঙ্কের ঋণ দিয়ে যাওয়ার কথা ফাঁস করেছেন।
এই ঘটনা নাগরিকদের মধ্যে আতঙ্ক সৃষ্টি করেছে এবং নানা রকম ভুল খবরও ছড়িয়ে পড়ছে, যার হদিশ পেতে এখানে এবং এখানে দেখুন।
স্বভাবতই এখন ব্যাঙ্কটি ক্ষুব্ধ গ্রাহক এবং আইনি কর্তৃপক্ষের ক্ষোভের মুখে পড়েছে।
পিএমসি ব্যাঙ্ক বিতর্ক নিয়ে যাবতীয় বিষয় বুম আপনাদের সামনে নিয়ে আসছে।
ব্যাঙ্কটির মূল ভিত্তি
১৯৮৪ সালে এই ব্যাঙ্কটি তৈরি হয় এবং এটি দেশের প্রথম ১০টি শহুরে সমবায় ব্যাঙ্কের মধ্যে স্থান করে নিয়েছে।
২০১৯ আর্থিক বছরের জন্য ব্যাঙ্কটির বার্ষিক রিপোর্টে দেখা যাচ্ছেঃ
- জমার পরিমাণ—১১,৬১৭ কোটি টাকা
- অগ্রিম দেওয়া হয়েছে—৮,৩০০ কোটি
- ব্যাঙ্কের কাজকর্মের পরিধি ১২৭টি শাখায় ছড়িয়ে রয়েছে
- মোট নন-পারফর্মিং অ্যাসেট (এনপিএ) ৩.৭৬ শতাংশ
পিএমসি ব্যাঙ্ক এবং এইচডিআইএল গোষ্ঠীর মধ্যে যোগসূত্রটি কী?
জয় টমাসের নোট অনুযায়ী বর্তমান সংকটের আগেও দু-দুবার পিএমসি ব্যাঙ্ক কঠিন পরিস্থিতির সম্মুখীন হয়েছিল। প্রতিটি ক্ষেত্রেই এইচডিআইএল গোষ্ঠীর ওয়াধওয়ান পরিবার তাদের সংকট থেকে উদ্ধার করে।
প্রথম সংকট দেখা দেয় ১৯৮৬ সালে, যখন ব্যাঙ্ক সদস্য/আমানতকারীদের বিভিন্ন বেআইনি ক্রিয়াকলাপের ফল ভোগ করছিল। সেই সময়েই ব্যাঙ্ক ওয়াধওয়ান পরিবারের সংস্পর্শে আসে এবং বর্তমানে প্রয়াত রাজেশ ওয়াধওয়ান এবং তার ভাই রাকেশ ওয়াধওয়ান (যিনি বর্তমানে এইচডিআইএল রিয়েল এস্টেট ফার্মের ডিরেক্টর) তাদের বিপুল অঙ্কের অর্থ জমা করে ব্যাঙ্ককে বাঁচিয়ে দেন।
দ্বিতীয় সংকটের কাল ২০০৪ সাল, যখন তিনটি পৃথক সমবায় ব্যাঙ্কের বিপর্যয়ের ধাক্কা পিএমসি-র উপর এসে পরে। তখনও রাজেশ ওয়াধওয়ান ১০০ কোটি টাকা ব্যাঙ্কে জমা দিয়ে তার নগদের সমস্যা সামলে দেন।
পিএমসি ব্যাঙ্কের সঙ্গে এইচডিআইএল-এর একটা আনুষ্ঠানিক সম্পর্ক গড়ে ওঠে, যেখানে বারংবার ওয়াধওয়ান পরিবার নিয়ন্ত্রিত সংস্থা ব্যাঙ্কের আয়ে অবদান রেখেছেন।
গোলমালটা কী হয়েছিল?
জয় টমাসের চিঠিতে প্রকাশ পায় যে, ব্যাঙ্ক কর্তৃপক্ষ তার অব্যবহারযোগ্য সম্পদ বা অনাদায়ী ঋণের (নন-পারফর্মিং অ্যাসেট) পরিমাণ অনেক কমিয়ে দেখিয়েছে, অন্তত রিজার্ভ ব্যাঙ্ককে দেওয়া হিসাবের চেয়ে তার পরিমাণ অনেক বেশি।
পাছে রিজার্ভ ব্যাঙ্ক কোনও শাস্তিমূলক ব্যবস্থা নেয়, তাই পিএমসি কর্তৃপক্ষ তার দেয়া টাকার হিসাবটা ঠিকমতো দেখায়নি (যেহেতু তারা ধরেই নিয়েছিল যে, এইচডিআইএল-এর কাছ থেকে তারা মোটা অঙ্কের টাকা পেয়েই যাবে)। কিন্তু ২০১৩ সালের পর থেকে এইচডিআইএল-এর ব্যবসাতেও মন্দা দেখা দেয়, ফলে তাদের কাছ থেকে মোটা অঙ্কের আমানত পেতে দেরি হতে থাকে।
উপরন্তু ২০১৭ সালে রিজার্ভ ব্যাংক হিসাবপত্র আরও খুঁটিয়ে পরীক্ষা করতে শুরু করলে ব্যাঙ্কের ব্যালান্স শিটে ওয়াধওয়ান গোষ্ঠীর আমানতগুলো উল্টেপাল্টে দেখানো হয়। রিজার্ভ ব্যাংকও আর ওই আমানতগুলো পরীক্ষা করে দেখেনি, যেহেতু সেগুলি জমা টাকার বদলে ঋণ হিসাবে দেখানো ছিল।
টমাসের চিঠিতে উল্লেখ নেই, তবে সংবাদসংস্থা রয়টার্স জানিয়েছে ওই ধরনের ভুয়ো অ্যাকাউন্টের সংখ্যা ২১ হাজার।
যদিও টমাসের চিঠিতে উল্লেখ নেই, তবু সংবাদমাধ্যমে প্রকাশ হয়েছে যে, পিএমসি-র অগ্রিম দেওয়া ৮,৩০০ কোটি টাকার মধ্যে ৬,৫০০ কেটি টাকাই এইচডিআইএল পায়। এইচডিআইএল নিজেই নানা সমস্যার মধ্যে রয়েছে এবং বর্তমানে জাতীয় কোম্পানি ল ট্রাইবুনালে দেউলিয়া ঘোষিত হওয়ার প্রক্রিয়ার দিকে এগোচ্ছে। ব্যাঙ্কের হিসাব-পরীক্ষকদের তরফেও অনেক ত্রুটি ও গাফিলতি থেকেছে, যদিও টমাসের চিঠিতে সেই সব ত্রুটির কারণ হিসাবে পর্যাপ্ত সময়ের অভাবকে নির্দেশ করা হয়েছে।
রিজার্ভ ব্যাঙ্কের ভূমিকা কী?
এই সব ত্রুটি-বিচ্যুতি আসলে গোটা ব্যাঙ্কিং ব্যবস্থার ব্যর্থতা নিয়েই প্রশ্ন তুলে দিয়েছে। রিজার্ভ ব্যাঙ্ক কী করে এমন বড় ধরনের অনিয়ম দেখতে পেল না এবং ব্যাঙ্কের অপরাধমূলক ক্রিয়াকলাপও তার নজর এড়িয়ে গেল, যে-সব কাজের জন্য এখন ব্যাংক বিচারপ্রক্রিয়ার সম্মুখীন?
সমবায় ব্যাঙ্কগুলির তত্ত্বাবধানের যে বন্দোবস্ত রিজার্ভ ব্যাঙ্কে রয়েছে, তা তত উন্নত মানের নয়, কিন্তু মুম্বই মিরর সংবাদপত্রের রিপোর্টে প্রকাশ, রিজার্ভ ব্যাঙ্ক ২০১৭-১৮ সালেই সরকারকে হুঁশিয়ার করেছিল যে, পিএমসি ব্যাংকের চেয়ারম্যান ওয়ারিয়াম সিং ওই সমবায় সংস্থা পরিচালনার যোগ্য ব্যক্তি নন। এইচডিআইএল-এর সঙ্গে ঘনিষ্ঠতার সুবাদেই চেয়ারম্যানের যোগ্যতা নিয়ে প্রশ্ন উঠেছিল।
২৪ সেপ্টেম্বরেই রিজার্ভ ব্যাঙ্ক পিএমসি ব্যাঙ্কের উপর বিভিন্ন নিয়ন্ত্রণ জারি করতে শুরু করে, যার কথা বুম এখানে উল্লেখ করেছিল। ১৮ সেপ্টেম্বর পিএমসি ব্যাঙ্ক কর্তৃপক্ষ তাদের অনিয়ম সম্পর্কে রিজার্ভ ব্যাঙ্ককে অবহিত করার পরেই এই নিয়ন্ত্রণ শুরু হয়। এই নিয়ন্ত্রণে আগামী ৬ মাসের জন্য ১ হাজার টাকার বেশি তোলা যাবে না বলে নির্দেশ দেওয়ায় সাধারণ গ্রাহক/আমানতকারীরা অসুবিধায় পড়ে যান।
তারপর যখন চাতুর্দিক থেকে প্রতিবাদ উঠতে শুরু করে, তখন রিজার্ভ ব্যাংক ওই নিয়ন্ত্রণ শিথিল করে আমানতকারীদের ১০ হাজার টাকা পর্যন্ত তোলার ছাড়পত্র দেয়।এর ফলে আমানতকারীদের ৬০ শতাংশই তাদের পুরো জমা টাকাই তুলে নিতে পারবেন।
রিজার্ভ ব্যাঙ্কের দ্বিতীয় বিজ্ঞপ্তিটি এখানে পড়তে পারেন।
এরপর কী?
ব্যাঙ্ক এইচডিআইএল-এর কাছ থেকে পুরো পাওনা উশুল করার একটা পরিকল্পনা পেশ করেছে।
তা হলো—সংস্থাটির স্থায়ী আমানত দিয়ে তার নেওয়া ঋণ উশুল করে নেওয়া, জাতীয় কোম্পানি ল ট্রাইবুনালের কাছে আর্জি জানানো এবং অন্যান্য ব্যাঙ্কে তার দেওয়া প্রতিশ্রুতির ভিত্তিতে তহবিল সংগ্রহ করা।
ইতিমধ্যে ব্যাঙ্কের চেয়ারম্যান টমাস ও অন্যান্য অফিসারদের বিরুদ্ধে এবং এইচডিআইএল-এর ওয়াধওয়ান পরিবারের বিরুদ্ধেও এফআইআর দায়ের হয়েছে। আর টমাসের বিরুদ্ধে একটা লুক-আউট নোটিশও জারি করা হয়েছে।