জুন মাসে ঝাড়খণ্ডে এক মুসলিম যুবককে পিটিয়ে মারার ঘটনা সোশাল মিডিয়ায় একের পর এক এ ধরনের বর্বরতার ঘটনার ভিডিও শেয়ার করার বন্যা বইয়ে দিয়েছে, যার মাধ্যমে সাম্প্রদায়িকতার বিষ ব্যাপকভাবে ছড়িয়ে দেওয়া হচ্ছে, আর যা সামাল দিতে তথ্য-যাচাইকারীরা হিমসিম খাচ্ছেন।
২০১৯ সালের ১৮ জুন তাবরেজ আনসারি নামে ঝাড়খণ্ডের এক মুসলিম যুবককে বৈদ্যুতিক পোস্টের সঙ্গে বেঁধে ঘন্টার পর ঘন্টা বেধড়ক পেটানো হয়। ওই বর্বর জনতা আনসারিকে ‘জয়শ্রীরাম’ ও ‘জয় হনুমান’ স্লোগান দিতেও বাধ্য করে। চার দিন পর ২২ জুন পুলিশ হেফাজতেই আনসারির মৃত্যু হয়।
ওই বর্বর নৃশংসতার ভিডিও ভাইরাল হওয়ার পর অনেকেই একে নরেন্দ্র মোদীর বিজেপি শাসিত ভারতে মুসলিম, মহিলা ও দলিতদের বর্ধমান হত্যার প্রমাণ হিসাবে তুলে ধরছেন।
একই মাসে আরও অন্তত দুটি এ রকম ঘটনা ঘটেছে, যেখানে মুসলিমদের মারধর করে ‘জয়শ্রীরাম’ বলতে বাধ্য করা হয়েছে। এ ব্যাপারে আরও জানতে এখানে এবং এখানে ক্লিক করুন।
এই সব ঘটনার প্রেক্ষিতে ফেসবুক, হোয়াটসঅ্যাপ ও টুইটারের মতো সোশাল মিডিয়ায় মুসলিমদের হাতে হিন্দুদের নিগ্রহের রক্তাক্ত, বীভত্স সব ভিডিও পাল্টা প্রকাশিত হতে শুরু করেছে গত বেশ কয়েক সপ্তাহ ধরে। অনেক ভিডিও ক্লিপই গণ-হিংসার ছবি এবং সেগুলি শেয়ার করে হিন্দু-মুসলিম সম্পর্ককে দারুণভাবে বিষিয়ে তোলার চেষ্টা হচ্ছে।
"যুবক সমাজ এই সব ভিডিও তত শেয়ার করছে না, কিন্তু মধ্যবয়স্করা এগুলো লুফে নিচ্ছে।"
অন্তত মুম্বইযের হিরনন্দানি হাসপাতালের মনঃচিকিৎসক ডাঃ হরিশ শেঠটি তেমনটাই মনে করছেন। তাঁর মতে, এ ধরনের ভিডিও দেখার ফলে দর্শকদের মনে উদ্বেগের মাত্রা বৃদ্ধি পায়।
"আগে থেকেই অসুস্থ যারা, তাদের মনে এই সব হাড়-হিম-করা দৃশ্য অনেক অবাঞ্ছিত অতীত স্মৃতি জাগিয়ে তোলে।"
ডাঃ শেঠটির মতে মূল ধারার সংবাদমাধ্যম জানানোর আগেই খবর পাওয়ার ও তা ছড়িয়ে দেবার ব্যাকুলতা এই সব ভিডিও শেয়ারকারীদের ক্ষেত্রে একটা তাড়না হয়ে ওঠে।
“অনেকেই আবার এটা ভেবে উত্তেজিত হয়ে পড়ে যে, এই নতুন ভিডিওটি সকলকে অবাক করে দেবে এবং সংবাদ-চ্যানেলগুলো যেমন টিআরপি রেটিংয়ের লোভে আগে ভাগে খবর পরিবেশেনে মরিয়া হয়ে ওঠে, এরাও তেমনই আচরণ করে।”
এই উত্তেজনা ও উৎসাহের চোটে অনেক সময় লাতিন আমেরিকার নৃশংস ঘটনার ছবি ও ভিডিও-ও দিব্যি ভারতের বলে চালিয়ে দেওয়া হয়। যেমন নীচে প্রদর্শিত ব্রাজিলের এই হত্যা-দৃশ্যটি।
ব্রাজিলে এক কিশোরকে কুপিয়ে হত্যা করার এই নৃশংস দৃশ্যের ভিডিওটি ভারতে পিটিয়ে মারার ভিডিও বলে চালিয়ে দেওয়া হয়েছে। এ ব্যাপারে আরও জানতে এখানে দেখুন।
একইভাবে বাংলাদেশে একটি বড় পাথর দিয়ে একজনকে হত্যা করার ভিডিওকে ভারতে মুসলিমদের দ্বারা হিন্দু যুবককে হত্যা করার দৃশ্য বলে চালানো হয়েছে। এ ব্যাপারে আরও পড়া যাবে এখানে।
শুধু হিন্দু-মুসলমানের সম্পর্ক নিয়েই নয়, দলিত এবং মহিলাদের উপর হামলার ঘটনার বেলাতেও এমনভাবে ভুল তথ্য পরিবেশন করা হচ্ছে যে, তার আড়ালে প্রায়শ ঢাকা পড়ে যাচ্ছে জনসমাজের এই সব প্রান্তিক গোষ্ঠীর দুরবস্থার প্রকৃত চিত্র। এ বিষয়ে আরও পড়ুন এখানে।
এই সব ভিডিওর চালাচালি মিডিয়ার উপর লোকের বিশ্বাসও নষ্ট করে দিচ্ছে।
উত্তরপ্রদেশের উন্নাও জেলায় এক আহত, রক্তাক্ত আইসক্রিম বিক্রেতার ছবি সোশাল মিডিয়ায় শেয়ার হয় এই বলে য়ে, এই হিন্দু লোকটিকে ভুলবশত মুসলিম ধরে নিয়ে তাকে ‘জয়শ্রীরাম’ না-বলার জন্য মারধর করা হয়েছে। অথচ তথ্য যাচাই করে দেখা যায়, লোকটি স্থানীয় গুণ্ডাদের সঙ্গে ঝামেলার জেরে প্রহৃত হয় এবং এই ঘটনার সঙ্গে কোনও সাম্প্রদায়িকতার যোগ নেই।
বার্লিনের একটি তথ্য-যাচাই উদ্যোগের প্রশিক্ষক ইওগান সুইনি বলেছেন, সোশাল মিডিয়ায় এমন অবিরাম, নিরবচ্ছিন্ন হিংসার ভিডিও আছড়ে পড়ায় সাংবাদিকদের বিশ্বাসযোগ্যতা ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে এবং সোশাল মিডিয়া ব্যবহারকারীরাও মানসিকভাবে অসংবেদী হয়ে উঠছে।
“কিছু কাল আগেও এ ধরনের ঘটনা বা দৃশ্য চট করে অধিকাংশ মানুষের নজরে আসত না। অথচ সোশাল মিডিয়ার দৌলতে এই ধরনের হিংসাত্মক আক্রমণ ও হত্যার ঘটনা লোকের কাছে জলভাত হয়ে গেছে। এর ফলে মানুষের সংবেদনশীলতা যে ভোঁতা হয়ে যাচ্ছে, সেটা অনুমান করা খুব কঠিন নয়।”
ইওগান সুইনি
সাংবাদিক ও অনলাইন তদন্তকারীদের তথ্য যাচাইয়ের প্রযুক্তি শেখাতেই সুইনি তাঁর সংস্থা ওসিন্ট এসেন্সিয়াল্স তৈরি করেন। তাঁর মতে, ক্রমাগত পুনঃপ্রচারিত এই ধরনের ভিডিওর প্রচার মানুষের মনে খুব দ্রুত বিরূপ প্রতিক্রিয়া সৃষ্টি করতে সক্ষম।
“অনেক দিন ধরে, মাঝখানে ছেদ দিয়ে-দিয়ে যে সব ঘটনা নানা সময়ে ঘটেছে, সেগুলিকে এখন একসঙ্গে, পর-পর দেখানো হচ্ছে, যার অপরিহার্য পরিণাম হচ্ছে মানুষের মনে এমন একটা আবেগ সঞ্চিত করা, যা বিস্ফোরণ ঘটানোর অপেক্ষায়।”