পিউ গবেষণা সংস্থার (Pew Survey Center) সমীক্ষায় প্রকাশ, গত কয়েক দশকে ভারতে সম্প্রদায়-নির্বিশেষে সন্তান উৎপাদনের হার দ্রুত (population growth) হ্রাস পেয়েছে।
চলতি বছরে এটি এই মার্কিন গবেষণা সংস্থার দ্বিতীয় সমীক্ষাপত্র। ইতিপূর্বে জুন মাসে প্রকাশিত প্রথম সমীক্ষাটিতে জানানো হয়েছিল, অধিকাংশ ভারতীয়ই অন্য ধর্মে এবং অন্য জাতে বিয়ে করতে অসম্মতl একটি সমীক্ষায় এ কথাও জানানো হয়েছিল যে ধর্মান্তরণ এ দেশে বিরল, মুসলিম বা খ্রিস্টানদের তুলনায় হিন্দুদের মধ্যে অপেক্ষাকৃত বেশি বিরল।
সর্বশেষ সমীক্ষায় জানানো হয়েছে, ১৯৫১ সাল থেকে ভারতের সাম্প্রদায়িক জনবিন্যাসের হারে খুব সামান্যই হেরফের হয়েছে, যার কারণ হচ্ছে সব ধর্ম-সম্প্রদায়ের মহিলাদের ক্ষেত্রেই সন্তান উৎপাদনের হার হ্রাস পাওয়া। এই হার নির্ধারণ করা হয়, কোনও মহিলা ভারতে গড়ে তাঁর জীবত্কালে কতগুলি সন্তানের জন্ম দেবেন, তার ভিত্তিতে।
এই ক্ষেত্রে মুসলিম মহিলাদের ঊর্বরতার হার সামান্য কিছু বেশি— ২.৬ শতাংশ, তার পরেই হিন্দু নারীদের ঊর্বরতার হার (২.১ শতাংশ)l তুলনায় জৈন সম্প্রদায়ে ঊর্বরতার হার সবচেয়ে কম— ১.২ শতাংশ। ৯০-এর দশক থেকে ঊর্বরতা হ্রাসের হার সবচেয়ে বেশি থেকেছে মুসলিম মহিলাদের মধ্যে— ৪.১ শতাংশ থেকে নেমে ২.৬ শতাংশে ঠেকেছে।
আর এর ফলেই সময়ের সঙ্গে-সঙ্গেই হিন্দু ও মুসলিম মহিলাদের ঊর্বরতার হার প্রায় কাছাকাছি চলে এসেছে। অন্যান্য সম্প্রদায়ের ক্ষেত্রেও একই ঘটনা লক্ষ্য করা যাচ্ছে— ভারতের বিভিন্ন সম্প্রদায়ের মহিলাদের মধ্যে সন্তান উৎপাদনের হারে কোনও বড় প্রভেদ থাকছে না।
ভারতের জনগণনা রিপোর্টের ভিত্তিতেই পিউ তার গবেষণাপত্রটি রচনা করেছে আর ঊর্বরতার হার সংক্রান্ত তথ্য পেতে ভিত্তি করেছে জাতীয় পরিবার স্বাস্থ্য সমীক্ষার (এনএফএইচএস)রিপোর্টকে।
জনসংখ্যা বৃদ্ধি
ভারতের জনসংখ্যা দেশ-ভাগের পর থেকে ৩ গুণের বেশি বেড়েছে— ১৯৫১য় ৩৬ কোটি ১০ লক্ষ থেকে ২০১১-তে ১২০ কোটি।
এদের মধ্যে হিন্দুরাই সবচেয়ে বড় সংখ্যাগরিষ্ঠ সম্প্রদায়— জনসংখ্যার ৭৯.৮ শতাংশ। মুসলিমরাও একটি বৃহত্ সংখ্যালঘু সম্প্রদায়, জনসংখ্যায় যাদের হার ৯.৮ শতাংশ থেকে বেড়ে ১৪.২ শতাংশে পৌঁছেছে।
সমীক্ষাটিতে আরও জানানো হয়েছে যে, ২০১১ সালের জনগণনার সময় অন্তত ৮০ লক্ষ মানুষ বলেছেন, তাঁরা দেশের ৬টি প্রধান ধর্ম-সম্প্রদায়ের কোনওটিরই সদস্য নন, যদিও তাঁরা সকলেই কোনও-না-কোনও ধর্মীয় গোষ্ঠীর অনুগামী। এর বাইরে মাত্র ৩০ হাজার ভারতীয় নিজেদের নিরীশ্বরবাদী বলে ঘোষণা করেছেন।
২০৫০ সালে ভারতের জনবিন্যাস যে রকম হবে
বর্তমান পরিসংখ্যানের ভিত্তিতেই সমীক্ষায় পূর্বাভাস দেওয়া হয়েছে ২০৫০ সালে ভারতের সাম্প্রদায়িক বিন্যাসের চিত্রটি কেমন হতে পারে।
তাতে পূর্বাভাস দেওয়া হয়েছে, ২০৫০ সালে হিন্দুরা এ দেশে ১৩০ কোটিতে পৌঁছে যাবে, মুসলিমদের জনসংখ্যা হবে ৩১ কোটি ১০ লক্ষ, খ্রিস্টানরা ৩ কোটি ৭০ লক্ষ।
"২০১১ সালের জনগণনায় মুসলিমরা যেখানে ১৪.২ শতাংশ ছিল, ২০২০ সালে তারা সম্ভবত ১৫ শতাংশে পৌঁছেছে। একই ভাবে হিন্দুরা ৭৯.৮ শতাংশ থেকে ২০২০তে ৭৯ শতাংশে আর খ্রিস্টানরা আগের মতোই ২ শতাংশেই দাঁড়িয়ে রয়েছে। সমীক্ষার পূর্বাভাস—২০৫০ সালে হিন্দুরা হবে ভারতের মোট জনসংখ্যার ৭৭ শতাংশ, মুসলিমরা ১৮ শতাংশ, খ্রিস্টানরা সেই ২ শতাংশই থাকবে l আর বৌদ্ধ, জৈন এবং শিখ নারীদের ঊর্বরতার হার যেহেতু জাতীয় গড়ের অনেক নীচে, তাই জনসংখ্যায় ওই সব সম্প্রদায়ের অংশ আরও হ্রাস পাবে।"
—পিউ রিসার্চ সেন্টার, ২০২১
ঊর্বরতা ও নারীর শিক্ষা
সমীক্ষাটি লক্ষ করেছে, নারীর শিক্ষিত হওয়ার সঙ্গে ঊর্বরতা হ্রাসের প্রত্যক্ষ ও নিবিড় সংযোগ রয়েছে-- মহিলাদের শিক্ষার হার যত বেড়েছে, সন্তান উৎপাদনের হার তত কমেছে।
দেখা গেছে, এক-একটি বছর করে শিক্ষা বাড়লে সেই অনুপাতেই সন্তানের জন্মহারও কমেছে। শিক্ষা, সম্পদ, বয়স এবং বাসস্থান— এই সব কিছুই নারীর ঊর্বরতা হ্রাসে নিয়ামক ভূমিকা পালন করে থাকে বলে লক্ষ করা গেছে।
যেমন খ্রিস্টানদের জনসংখ্যা থমকে থাকার একটা কারণই হল খ্রিস্টান মহিলাদের অপেক্ষাকৃত বেশি শিক্ষিত হওয়ার প্রবণতা।
ধর্মান্তরণের প্রবণতা হ্রাস
পিউ-র সমীক্ষায় দেখা গেছে, ভারতে ধর্মান্তরণের ঘটনা বিরল। হিন্দু হিসাবে বড় হওয়া লোকেদের ৯৯ শতাংশই এখনও হিন্দুই রয়েছে। একই ভাবে ইসলামের ঘরানায় বেড়ে ওঠা ৯৭ শতাংশ মুসলমানই এখনও মুসলিমই রয়েছেন। আর খ্রিস্টান হিসাবে বেড়ে ওঠা লোকেদের ৯৪ শতাংশই এখনও খ্রিস্টধর্মেরই অনুগামী।
পিউ লক্ষ করেছে, বিভিন্ন সম্প্রদায় থেকে যারা ধর্মান্তরিত হয়, তারা 'পরস্পরকে বাতিল করে' অর্থাৎ ধর্মান্তরিতের সংখ্যাটা প্রায় একই রয়ে যায়।
যেমন প্রাপ্তবয়স্ক ভারতীয়দের মধ্যে ০.৭ শতাংশ হিন্দু হিসাবে বেড়ে উঠলেও এখন আর নিজেদের হিন্দু বলে না, অর্থাৎ অন্য ধর্মে অন্তরিত হয়েছে। আবার উল্টো দিকে হিন্দু ধর্মের বাইরে অন্য পরিচয়ে বেড়ে ওঠা লোকেদের ৮ শতাংশ এখন নিজেদের হিন্দু বলে পরিচয় দেয়। হরে-দরে ধর্মান্তরিতের সংখ্যাটা অতএব একই দাঁড়াচ্ছে।
অধিকাংশ প্রদেশেই হিন্দুরাই সংখ্যাগরিষ্ঠ
উত্তরপ্রদেশ, মহারাষ্ট্র ও বিহার সহ দেশের ৩৫টি প্রদেশ ও কেন্দ্রশাসিত অঞ্চলের মধ্যে ২৮টিতেই হিন্দুরাই সংখ্যাগরিষ্ঠ।
দেশের মাত্র ২টি কেন্দ্রশাসিত অঞ্চল জম্মু-কাশ্মীর ও লাক্ষাদ্বীপে মুসলিমরা সংখ্যাগরিষ্ঠ। কিন্তু এই দুই অঞ্চলে দেশের মোট মুসলিম জনসংখ্যার মাত্র ৫ শতাংশ বাস করে। বাকি ৯৫ শতাংশ মুসলিম দেশের অবশিষ্ট রাজ্যগুলিতে ছড়িয়ে রয়েছে, যেখানে সর্বত্রই তারা ধর্মীয় সংখ্যালঘু।
আবার খ্রিস্টানরা দেশের ৩টি রাজ্য নাগাল্যান্ড (২০ লক্ষ), মিজোরাম (১০ লক্ষ) এবং মেঘালয়ে (৩০ লক্ষ)সংখ্যাগরিষ্ঠ।
আরও পড়ুন: অভিনেতা সোনু সুদের ভুয়ো অ্যাকাউন্ট থেকে প্রধানমন্ত্রী বদলানোর ডাক