ফেব্রুয়ারির শেষ সপ্তাহে, মণিপুরের মুখ্যমন্ত্রী এন বীরেন সিংহর (N Biren Singh) একটি ছবি সোশাল মিডিয়ায় ঝড় তোলে। ছবিটি সিংহ নিজেই সোশাল মিডিয়ায় শেয়ার করেন। ছবিটির ক্যাপশনে উনি বলেন, "মণিপুরের সংস্কৃতি আর রীতি দেখে আমি মুগ্ধ। কী অনুশাসন। ছবিটিতে সিংহকে লাল কার্পেটের ওপর দিয়ে হেঁটে যেতে দেখা যাচ্ছে আর দু'দিকে সারিবদ্ধ ছাত্র-ছাত্রীরা মাটিত মাথা ঠেকিয়ে গড় করছেন।
সোশাল মিডিয়া ব্যবহারকারীরা সিংহর সমালোচনা করে বলেন, বাচ্চাদের সামনে উনি খুব নেতিবাচক নিদর্শন স্থাপন করলেন। এবং নেতা হিসেবে তাঁর নিজের মান আরও উন্নত করার কথা বলেন তাঁরা। ব্যবহারকারীরা বলেন, একমাত্র ভগবান, বাবা-মা আর শিক্ষকদের সামনেই বাচ্চারা নতজানু হতে পারে। কেউ কেউ দাবি করেন, পড়ুয়াদের ওই ভাবে গড় করতে বাধ্য করা হয়।
বেআইনি গাঁজা চাষের বিরুদ্ধে সব সম্প্রদায়ের প্রতিনিধিদের এক সভায়, আমন্ত্রিত হয়েছিলেন বীরেন সিংহ। ওই সভা ডেকে ছিল মেইতেই লুপুন। মণিপুরে যথেচ্ছ মাদক ব্যবহার বন্ধ করতে 'মাদকের বিরুদ্ধে যুদ্ধ' ঘোষণা করেছেন বীরেন সিংহ।ওই অভিযানের সেটির অঙ্গ ছিল।
বাতিল প্রথা
বুম মেইতেয়ী সম্প্রদায়ের মানুষজনের সঙ্গে কথা বলে। তাঁরা বলেন বাচ্চারা কেবল তাদের বাবা-মাকে সম্মান জানাতে ওই ভাবে গড় করে। কোনও নেতার ক্ষেত্রে তেমনটা করে না।
একজন মণিপুরী সাংবাদিক বলেন, ওই ভাবে কোনও নেতার সামনে গড় করার প্রথা সেই রাজারাজরাদের সময়ে চালু ছিল।
"পুরনো দিনে, রাজতন্ত্র ও সামন্ততন্ত্রের যুগে, ওই প্রথা চালু ছিল। কিন্তু এখন তা বাতিল হয়ে গেছে। এটি একটি বিক্ষিপ্ত ঘটনা। এই প্রথা আর চালু নেই। এটি আর সংস্কৃতির অঙ্গও নয়," বলেন নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক ওই সাংবাদিক।
নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক এক ছাত্র বুমকে বলেন, "বড়দের অভ্যর্থনা করতে বা তাদের বিদায় নেওয়ার সময় ওই ভাবে গড় করা হয়। সেটি একটি সাংস্কৃতিক রীতি, যেটি পরিবারের সদস্যদের মধ্যেই সীমাবদ্ধ থাকে। তবে (মুখ্যমন্ত্রীর সামনে) ওই ভাবে গড় করার পক্ষপাতী নই আমি। বিশেষ করে যাঁর ক্ষমতা বেশি, তাঁকে ভগবানের আসনে বসানোর এই চেষ্টার।"
দিল্লির মনিপুরী ছাত্র, বুধাজ্ঞান নিঙ্গথৌজাম বুমকে বলেন, "আমার জীবনে, আমি আমার বাবা-মা ছাড়া আর কারও সামনে গড় করিনি। আমি জানি না ওই সভার আয়োজকরা কেন দাবি করছেন যে, ওটি একটি রীতি বা ঐতিহ্য। সেটা বেশ অদ্ভুত।"
ওই ছাত্রটি আরও বলেন, "আমি একজন মেইতেয়ী। আমরা এ রকম করি না। কখনও কখনও আমরা আমাদের বাবা-মা আর শিক্ষকদের সামনে গড় করি। কিন্তু কখনওই কোনও নেতার সামনে নয়। সম্ভবত মুখ্যমন্ত্রীকে খুশি করতে আয়োজকরা পড়ুয়াদের দিয়ে ওই কাজ করান।
আরও পড়ুন: কৃষক বিক্ষোভ: পুরনো ছবি ও ভিডিওতে ভুয়ো খবরের ছড়াছড়ি
আয়োজকরা কী বলছেন?
আমরা বীরেন সিংহর অফিসের সঙ্গে যোগাযোগ করি। সেখান থেকে আমাদের ওই অনুষ্ঠানের আয়োজক প্রমথ সিংহর সঙ্গে যোগাযোগ করতে বলা হয়।
মেইতেয়ী লুপুন-এর সদস্য প্রমথ সিংহ, ব্যাপারটি সমর্থন করেন। উনি বলেন, ওই ভাবে গড় করেই গুরুজনদের সম্মান জানানোর রীতি আছে মেইতেয়ী সংস্কৃতিতে। প্রমথ সিংহ হলেন মুষ্টিমেয় কয়েকজনের একজন, যাঁরা বীরেন সিংহর পদ সম্পর্কে ইতিবাচক কথা বলেন। উনি বলেন, অতিথিদের ভগবান মনে করে তাঁদের সামনে গড় করাটা হল মেইতেয়ী রীতি।
একটি পরবর্তী পোস্টে প্রমথ সিংহ লেখেন যে, "খৈরুম্বা" নামক গড় করে সম্মান জানানোর ওই প্রথাকে কিছু "শিক্ষিত" ব্যক্তি লজ্জাজনক কাজ বলে বর্ণনা করছেন।
প্রমথ সিংহ বুমকে বলেন, একটি ঐতিহাসিক সম্মেলন, যাতে ৩৩ টি মণিপুরী আদিবাসী গোষ্ঠী এক বিশেষ লক্ষ্যে একত্রিত হয়। সেটির ওপর নজর না দিয়ে, কিছু ঈর্ষা-পরায়ন লোক কেবল একটি ছবির ওপরই দৃষ্টিপাত করছেন।
"ইতিহাসে এই প্রথম, মেইতেয়ী গোষ্ঠীগুলি একটি যৌথ লক্ষ্য অর্জন করতে একত্রিত হয়েছে। সেই জন্য কিছু লোকের বোধহয় খুব ঈর্ষা হচ্ছে। আইটি গ্রুপগুলি তো এমন প্রচার করছে যেন, ওই সম্মেলন রাজ্যপাল আয়োজন করেছেন," বলেন প্রমথ সিংহ।
ছাত্রদের গড় করতে হল কেন? এই প্রশ্নের উত্তরে, প্রমথ সিংহ বলেন, অতিথিদের সামনে তারা আগেও গড় করেছে। এবারেও তার ব্যতিক্রম হয়নি।
"এই ভাবেই আমরা অতিথিদের অভ্যর্থনা জানানোর পরিকল্পনা করেছিলাম। শুধু এই অনুষ্ঠানই নয়, সব অনুষ্ঠানেই আমরা খৈরুম্বা করে থাকি।আমরা মেইতেয়ী সংস্কৃতির পুনরজাগরণের চেষ্টা করছি। আমাদের একটা সমৃদ্ধ সংস্কৃতি আছে। কিন্তু সেটি নষ্ট হয়ে যাচ্ছে," বলেন প্রমথ সিংহ।
উনি আরও বলেন যে, ছবিতে যে বাচ্চাদের দেখা যাচ্ছে তারা সবাই মেইতেয়ী লুপিন-এর থাঙ্গ-টা টিমের সদস্য। থাঙ্গ-টা হল একটি মণিপুরী মার্শাল আর্ট। 'থাঙ্গ' শব্দটির মানে তলোয়ার আর 'টা' শব্দের মানে বর্ষা।
প্রমথ সিংহ আমাদের সঙ্গে রবীন্দ্র সিংহর যোগাযোগ করিয়ে দেন। ছবিতে রয়েছে, এমন দু'টি ছেলের অবিভাবক হলেন রবীন্দ্র সিংহ। উনি বলেন, তাঁর ভাইরা, মেইতেয়ী লুপিন-এর খুরাল থাঙ্গ-টা টিমের সদস্য। এবং মেইতেয়ী সংস্কৃতির অঙ্গ হিসেবে তারা গুরুজন আর শিক্ষকদের সামনে সব সময়ই গড় করে সম্মান জানান। উনি থাঙ্গ-টা টিমের প্রশিক্ষণ ও বড়দের সামনে বাচ্চাদের গড় করার ছবি দেখান। এই দাবি বুম আলাদা করে যাচাই করে দেখতে পারেনি।
প্রমথ সিংহ বলেন যে, মেইতেয়ী লুপিন তাদের কাজ বাড়িয়ে যাবে। এবং পরের অনুষ্ঠানে আরও বড় আকারের খৈরুম্বা অভ্যর্থনার আয়োজন করা হবে।
"পরের অনুষ্ঠান হবে ২৭ মে। সেই সময় ৫০০ জন মেইতেয়ী যাতে খৈরুম্বা করতে পারেন, আমরা সেই আয়োজন করছি," বলেন সিংহ।
ট্রাইবাল নেতাদেরও কি একই ভাবে অভ্যর্থনা করা হয়? এই প্রশ্নের উত্তরে উনি বলেন, সব ছবিই ফেসবুক পেজে দেওয়া রয়েছে। কিন্তু ওই অনুষ্ঠানের ওই ধরনের আর কোনও ছবি বুম দেখতে পায়নি।
মেইতেয়ী লুপুন কারা?
প্রমথ সিংহ বলেন, মেইতেয়ী লুপুন হল এমন একটি সংগঠন যেটি মেইতেয়ী সংস্কৃতির পুনরুজ্জীবন ঘটানোর চেষ্টা করছে। তাঁর মতে, মেইতেয়ী লুপুন প্রচার থেকে দূরে থেকে চুপচাপ কাজ করে যায়।
"আমরা ইমফলে থাকি। আমাদের রাজা, যিনি আমাদের এমপিও, তিনিও ইমফলে থাকেন। আমরা আমাদের রাজার অধীনে আছি। সে কথা বলতে আমাদের কোনও দ্বিধা নেই। আমরা কোনও আন্ডারগ্রাউন্ড বা গোপন সংগঠন নই। তবে আমরা কখনও মিডিয়ার কাছে যাই না। আমরা প্রচারবিমুখ। আমরা খবরের কাগজে নেই। কিন্তু পাহাড়ে, উপত্যকায়, বাকি সব জায়গায় আমরা আছি। আমরা ওই ভাবেই কাজ করি," বলেন প্রমথ হিংহ।
মণিপুরের প্রতীকী রাজা হলেন লাইসেম্বা সানাজাওবা। উনি ক্ষমতাসীন ভারতীয় জনতা পার্টির সদস্য এবং মণিপুরের একমাত্র রাজ্যসভা এমপি। তাঁর প্রার্থী হওয়ার বিরুদ্ধে ছিলেন অনেকে। কারণ, তাঁরা মনে করেছিলেন যে, রাজা হয়ে ইলেকশনে লড়া তাঁর পক্ষে শোভা পায় না। মেইতেয়ী লুপুন অবশ্য তাঁর প্রার্থী হওয়াকে সমর্থন করেছিল।
প্রমথ সিংহ বলেন, মেইতেয়ী লুপুন একটি অরাজনৈতিক সংগঠন। কিন্তু গণতান্ত্রিক পদ্ধতিতে যেই নির্বাচিত হন না কেন, তাঁরা সেই নির্বাচিত ব্যক্তির সঙ্গে কাজ করেন।
"আমাদের সংস্কৃতি পেছনে সরে যাচ্ছে। তাই আমাদের সংস্কৃতি লোকজন বুঝতে পারে না। এখন যদি আমরা মাটিতে গড় করি, তাহলে অনেকে মনে করে আমরা ভিক্ষে করছি। যখনই কোনও অতিথি আসেন, আমরা তাঁকে সম্মান জানাতে গড় করি। সেনাপতি জেলায় কিছু গোষ্ঠীর মধ্যে একটা কথা আছে। বলা হয়, বিপদে পড়লে, একজন মেইতেয়ীর বাড়িতে যান। কোনও মেইতেয়ী তাঁর অতিথির ক্ষতি করে না। তিনি আপনাকে নতজানু হয়ে অভ্যর্থনা জানাবেন। আপনাকে সম্মান করবেন। সেই মেইতেয়ী সংস্কৃতি হারিয়ে যাচ্ছে। আমরা সেটিকে আবার আস্তে আস্তে পুনরুজ্জীবিত করার চেষ্টা করছি," বলেন প্রমথ সিংহ।
মেইতেয়ী লুপুন থাঙ্গ-টা মার্শাল আর্টের জনপ্রিয়তা বাড়িয়ে মনিপুরী সংস্কৃতিকে উজ্জীবিত করার চেষ্টা করছে। প্রমথ সিংহ দাবি করেন যে, প্রতিটি পাড়ায় থাঙ্গ-টা টিম রয়েছে, যারা অল্প সময়ের নোটিসেই তাঁদের খেলা দেখাতে পারেন।
"আমাদের সমাজের যুবক ও অবিবাহিত লোকেরা থাঙ্গ-টা অনুশীলন করেন। আমাদের রাজার আমলে প্রতিটি বাড়িতেই ঘোড়া আর অস্ত্র থাকত। যাতে যুদ্ধের সময় আমরা খুব তাড়াতারি তৈরি হয়ে নিতে পারতাম। কিন্তু এই প্রথাটিকে ইংরেজরা বন্ধ করে দেয়। তারা বলে, এটা এক ধরনের দাস প্রথা। অর্থ ব্যয় না করে একটি সেনাবাহিনী রাখা যায় না। এখন আমরা সেই প্রথাটি আবার জাগিয়ে তুলছি।
"পাড়ায় পাড়ায় এখন আমাদের স্বেচ্ছাসেবীরা রয়েছে। তারা জানতে চাইছিল যে, আমাদের সংস্কৃতিকে অপমান করছে যারা তাদের কী করা উচিত? কিন্তু আমি কোনও নির্দেশ দিই নি," হাল্কাভাবেই বলেন প্রমথ সিংহ।
আরও পড়ুন: আমির খানের মেয়ে ইরা খানকে লক্ষ্য করে ভুয়ো সাম্প্রদায়িক দাবি করা হল