একটা ভাল ষড়যন্ত্রের তত্ত্ব সকলেই পছন্দ করেন। 'টুপাক (Tupac) বেঁচে আছে', 'এরিয়া-৫১' (area 51) 'গিরগিটি মানুষ রাজ করছে পৃথিবীতে', 'বিগফুট' (bigfoot) ও 'ইলুমিনাটি'র মত ষড়যন্ত্রের বিচিত্র সব গল্প এখন আমাদের সাংকৃতিক জগতে স্থান করে নিয়েছে।
কিছু ষড়যন্ত্রের তত্ত্ব বা থিওরি নিরীহ প্রকৃতির। এমনকি বেশ মজারও বলা চলে। কিন্তু কিছু আছে যেগুলি ভয় আর বিরোধ সৃষ্টি করে। ২০২০ এমনই একটি বছর, যেটিতে বেশ কয়েকটি বিপজ্জনক ও ক্ষতিকর ষড়যন্ত্রের তত্ত্ব ছড়ানো হয়। এখানে ২০২০-র চারটি সবচেয়ে চালু তত্ত্বের কথা উল্লেখ করা হল।
১) সুশান্ত সিংহ রাজপুতের মৃত্যু ও তাঁর জন্য ন্যায় বিচারের অভিযান
১৪ জুন, ২০২০ তে, অভিনেতা সুশান্ত সিংহ রাজপুত মুম্বইয়ে তাঁর বান্দ্রার ফ্ল্যাটে আত্মহত্যা করেন। প্রাথমিক ভাবে তাঁর মৃত্যুতে তাঁর অনুগামী ও সহ তারকারা স্তম্ভিত হন। কিন্তু তারপর তাঁর মৃত্যৃকে ঘিরে শুরু হয় এক লম্বা ও ভারতের সবচেয়ে বড় ষড়যন্ত্রের তত্ত্ব।
অভিনেতার অনুগামী ও বেশ কিছু স্বঘোষিত সমাজকর্মী #জাস্টিসফরএসএসআর প্রচার অভিযান শুরু করেন। ওই ধরনের হ্যাশট্যাগগুলি দীর্ঘ দিন সোশাল মিডিয়ার শীর্ষে ছিল। ষড়যন্ত্র তত্ত্ব যাঁরা খাড়া করেছিলেন, তাঁদের প্রধান অভিযোগ ছিল, রাজপুতকে খুন করা হয়। এই মতকে প্রচার ও প্রতিষ্ঠা করার জন্য রাতারাতি বেশ কিছু ফেসবুক পেজ খোলা হয়। এঁদের মধ্যে অনেকে বলতে থাকেন যে, অভিনেতাকে আত্মহত্যা করতে বাধ্য করা হয়। অনেকে আবার মৃতের শরীরের নানা 'চিহ্ন' বিশ্লেষণ করে ফরেনসিক বিশেষজ্ঞের ভূমিকায় অবতীর্ণ হন।
তাঁর মৃত্যুকে ঘিরে যে ষড়যন্ত্রের কাহিনীর জাল বোনা হয়, তাতে এও দাবি করা হয় যে, তাঁর প্রাক্তন ম্যানেজার দিশা সাল্লানার কথিত ধর্ষণ ও হত্যা সংক্রান্ত্র তথ্য ধামাচাপা দেওয়ার জন্য কিছু রাজনৈতিক নেতা ও বলিউডের তারকাদের এক চক্র রাজপুতকে খুন করে। ৯ জুন, ২০২০ তে সাল্লানা অত্মহত্যা করেন। এই দাবিগুলি ক্রমশ আবেগের স্তর থেকে অবাস্তব পর্যায়ে পৌঁছে যায়। এবং সব শেষে মিথ্যে খবর প্রচারে পর্যবসিত হয়।
সে রকম কয়েকটি মিথ্যা খবর বুম নস্যাৎ করে। তার মধ্যে একটিতে বলা হয়েছিল যে, অভিনেতা আদিত্য পঞ্চলি প্রমাণ লোপাট করতে একজন পুলিশ অফিসার সেজে রাজপুতের বাড়ি গিয়েছিলেন। অন্য একটিতে অভিনেত্রী দিশা পাটানির ছবি ব্যবহার করে দাবি করা হয় যে, আদিত্য ঠাকরের সঙ্গে রাজপুতের বান্ধবী রিয়া চক্রবর্তীর সম্পর্ক গড়ে ওঠার ফলে, চক্রবর্তী রাজপুতকে হত্যা করার ষড়যন্ত্র করেন। তবে সব চেয়ে অবাস্তব দাবি ছিল যে, রাজপুতের পরিকল্পিতএকটি গেমের অ্যাপের ছক হাতানোর জন্য অভিনেতাকে খুন করা হয়। ওই পেজগুলি থেকে মহারাষ্ট্র সরকারের বিরুদ্ধেও প্রচার চালানো হয়। এবং মুম্বাই পুলিশের তদন্তের সমালোচনাও করা হতে থাকে।
ভারতের 'কিউঅ্যানন' (QAnon) মুহূর্ত #জাস্টিসফরএসএসআর সম্পর্কে বিস্তারিত জানুন 'ইকনমিক টাইমস'এর এই বিস্তারিত অনুসন্ধান থেকে।
২) কিউঅ্যানন
ডোনাল্ড ট্রাম্প বারবার বেশ ক্ষতিকর কিছু মিথ্যে খবর ছড়িয়েছেন, যেগুলির উৎস হল কিউঅ্যানন নামের এক গোষ্ঠী। তারা মনে করে, পৃথিবীকে চালনা করছে এক ধরনের শিশু নির্যাতনকারীর দল, যারা আবার শয়তানেরও উপাসক। তারা ট্রাম্পকে উৎখাত করার চেষ্টা চালাচ্ছে। এবং তাদের ওই কার্যকলাপকে অভ্যন্তরীণ সন্ত্রাসবাদ বলে বর্ণনা করেছে ফেডারেল ব্যুরো অফ ইনভেস্টিগেশন।
তাঁদের কথা অনুযায়ী, একটা দিন আসবে যখন ট্রাম্পের নেতৃত্বে একটা ঝড় উঠবে। তার ফলে ওই শয়তানের উপাসকরা ধরা পড়বে ও তাদের প্রাণদণ্ড কার্যকর করা হবে। বুম আগে কিউঅ্যানন-এর ওপর প্রতিবেদন লিখে ছিল এবং তাতে কিউঅ্যানন-এর উৎস সম্পর্কে বিস্তারিত আলোচনা করা হয়।
ট্রাম্প ওই কিউঅ্যানন গোষ্ঠীকে প্রচারের আলোয় আনেন। যেমন, মার্কিন নৌবাহিনীর এক সদস্যের হত্যার ঘটনাকে নাকি বারাক ওবামা ও জো বাইডেন ধামাচাপা দেন। কিউঅ্যানন-এর এই দাবিকে ট্রাম্প পুণঃপ্রচার করেন। ৪ নভেম্বর, মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে নির্বাচন শেষ হয়ে যাওয়ার পর, কিউঅ্যানন-এর আরও একটি দাবিকে ভিত্তি করে ট্রাম্প প্রচার করতে থাকেন। তাতে বলা হয় যে, মার্কিন ভোটে ব্যবহৃত ডোমিনিয়ন ভোটিং সিসটেম যে কোম্পানি তৈরি করেছিল, তারা নাকি ট্রাম্পের পক্ষে-পড়া কয়েক লক্ষ ভোট মুছে দেয়।
২০২০তে দাবালের সময়, কিউঅ্যানন দাবি করে যে, ওরেগন-এ পরিত্যক্ত ঘরবাড়ি লুট করার জন্য অ্যান্টিফা-র সমর্থকরা আগুন লাগিয়ে দেয়।
৩) 'দ্য গ্রেট রিসেট' ও কোভিড -১৯ অতিমারি
ওয়ার্ল্ড ইকনমিক ফোরাম কোভিড-১৯ অতিমারির পর কী ভাবে বিশ্ব অর্থনীতিকে নতুন করে সাজাতে হবে, সে সম্পর্কে একটি প্রস্তাব দেয়। ওই প্রস্তাবটির নাম দেওয়া হয়, 'দ্য গ্রেট রিসেট' (বা মহা পুনর্বিন্যাস)। কিন্তু ষড়যন্ত্র তত্ত্বের প্রবক্তারা দাবি করেন যে, দ্য গ্রেট রিসেট থেকে স্পষ্ট হয়ে যায় যে, রাজনীতিবিদ ও বিশ্ব নেতারা বিশ্বের অর্থনীতির ওপর দখল নেওয়ার জন্য, নিজেরাই অতিমারি সৃষ্টি করেছেন।
দ্য গ্রেট রিসেট-এ প্রস্তাবকে বিকৃত করে দক্ষিণপন্থীরা দাবি করেন যে, জর্জ সোরস ও বিল গেটস-এর নেতৃত্বে এক দল রাজনৈতিক নেতা কোভিড-১৯ অতিমারিকে ব্যবহার করে একটি নতুন সমাজতান্ত্রিক ব্যবস্থা তৈরি করতে চাইছেন। তাতে সর্বজনীন স্বাস্থ্য পরিষেবার পক্ষে ও জলবায়ু পরিবর্তন রোধের লক্ষ্যে কাজ করা হবে। তার ফলে, মানুষ তাঁদের অধিকার খোয়াবেন।
বিবিসি জানায় যে, কোনও দেশের অর্থনীতিকে নিয়ন্ত্রণ করার ক্ষমতা ওয়ার্ল্ড ইকনমিক ফোরামের নেই। তাছাড়া, নভেল করোনাভাইরাস যে মানুষের সৃষ্টি নয়, সে বিষয়ে যথেষ্ট প্রমাণ রয়েছে। আর বিশ্বের রাজনৈতিক নেতারা একজোট হয়ে নতুন বিশ্ব ব্যবস্থা তৈরি করতে চলেছেন, এ এক অতি অবাস্তব ধারণা।
৪) বিল গেটস ও কোভিড-১৯
কোভিড-১৯ অতিমারির উৎস, তার গুরুত্ব ও ভ্যাকসিন সম্পর্কে রাশি রাশি মিথ্যে তথ্য ছড়ানো হয়েছে। অতিমারির শুরু থেকেই মাইক্রোসফ্ট-এর প্রতিষ্ঠাতা ও ধনপতি ফিলানথ্রপিস্ট বিল গেটস বিভিন্ন ষড়যন্ত্র তত্ত্বের শিকার হয়েছেন।
বিল অ্যান্ড মিলিন্ডা গেট্স ফাউন্ডেশন-এর মাধ্যমে, বিল গেটস নানান ভ্যাকসিন প্রকল্পকে সমর্থন করে থাকেন। কোভিড-১৯-এর ক্ষেত্রেও অর্থনৈতিক ভাবে দুর্বলদের কাছে যাতে ভ্যাকসিন পৌঁছন যায়, তার জন্য চেষ্টা চালাচ্ছেন গেটস। তাছাড়া অতিমারি সংক্রান্ত বিষয়েও তিনি গবেষণা করছেন। এবং ২০১৫ সালে উনি আগাম বলেছিলেন যে, অতিমারির মোকাবিলা করার জন্য বিশ্ব প্রস্তুত নয়।
ষড়যন্ত্র থিওরির প্রবক্তারা গেট্স-এর বিরুদ্ধে একাধিক অভিযোগ এনেছেন। সেগুলি হল:
১) গেটস নভেল করোনাভাইরাস তৈরি করেছেন
২) গেটস ভ্যাকসিনের মধ্যে মাইক্রোচিপ ঢুকিয়ে দিচ্ছেন। তার ফলে, একজন ব্যক্তির সব ব্যক্তিগত তথ্য পেয়ে যাবেন উনি। অন্য একটি থিওরিতে দাবি করা হয়েছে যে, আরটি-পিসিআর টেস্টও হল শরীরে মাইক্রোচিপ ঢুকিয়ে দেওয়ার একটি উপায়।
৩) বিল অ্যান্ড মিলিন্ডা গেটস ফাউন্ডেশন আফ্রিকা ও ভারতে শিশুদের ওপর ভ্যাকসিন পরীক্ষা করে। তার ফলে, অনেক বাচ্চা মারা যায়। অন্য একটি থিওরিতে দাবি করা হয় যে, ভ্যাকসিনটি মহিলাদের বন্ধ্যা করে দেবে।
৪) ভ্যাকসিন তৈরি করার মাধ্যমে বিল গেটস ২০০ বিলিয়ন ডলার আয় করবেন।
এই সব দাবিগুলিই মিথ্যে। সিবিএস নিউজ-কে দেওয়া এক সাক্ষাৎকারে বিল গেটস নি্জেই এই থিওরিগুলি খণ্ডন করেন। কোভিড-১৯ আর বিল গেটসকে ঘিরে যে ষড়যন্ত্র-থিওরিগুলি চালু হয়েছিল সেগুলি এখানে দেখা যাবে।