নূন্যতম সহায়ক মূল্য (এমএসপি) হল উচ্চ ফলনশীল শস্যের নূন্যতম দাম যা সরকার স্থির করে এবং ওই দামে চাষীদের কাছ থেকে শস্য কেনে। এখন ওই নূন্যতম সহায়ক মূল্যই সরকারের সঙ্গে কৃষকদের বিরোধের একটি বড় কারণ হয়ে দাঁড়িয়েছে। তাঁরা কেন্দ্রের নতুন কৃষি আইন প্রত্যাহারের দাবি তুলেছেন।
বিক্ষোভকারী ও সরকারের সমালোচকরা দাবি করছেন যে, নতুন কৃষি সংস্কার আইনের ফলে বর্তমান এপিএমসি চালিত মান্ডিগুলি অবান্তর হয়ে পড়বে ও কর্পোরেট বা বড় কোম্পানিগুলির প্রভাব বিস্তার করার পথ প্রশস্ত হবে। এবং কৃষকদের কাছে আজকের সুবিধেজনক ও স্থিতিশীল মূল্য ব্যবস্থা বানচাল হয়ে যাবে। অন্যদিকে, এই আইনের সমর্থকরা সরকারি বক্তব্যের সঙ্গে সুর মিলিয়ে বলছেন যে, কৃষকদের খোলা বাজারে তাঁদের দ্রব্য বিক্রি করতে সাহায্য করবে এই আইন। এবং তার ফলে, তাঁরা তাঁদের পণ্যের জন্য ভালো দাম পেতে পরেন। প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদী দাবি করেছেন যে, বিরোধী দলগুলি ও কায়েমি স্বার্থ এই আইনটি সম্পর্কে বিভ্রান্তি সৃষ্টি করার ফলে চাষীদের মধ্যে বিক্ষোভ সৃষ্টি হয়েছে। আবার কিছু বিশেষজ্ঞ মনে করছেন যে, সরকার আশ্বাস দিয়েছেন, নূন্যতম সহায়ক মূল্য এবং সরকারি ক্রয় ব্যবস্থা বহাল থাকবে। কিন্তু তাঁরা সেই বার্তাটিকে কৃষকদের কাছে জোরালোভাবে পৌঁছে দিতে পারেননি।
অবশ্য, নূন্যতম সহায়ক মূল্যের বিষয়টা যথেষ্ট জটিল। এবং কৃষকদের ওপর তার প্রভাবটা নির্ভর করে কি ধরনের শস্য, কোন রাজ্যে উৎপাদন করা হচ্ছে, তার ওপর।
নূন্যতম সহায়ক মূল্য কি ও কী ভাবে তা ঠিক করা হয়?
নূন্যতম সহায়ক মূল্য স্থির করে সরকার। সেটা হল নূন্যতম দাম যা দিয়ে সরকার চাষীর পণ্য কেনে। সরকারের তরফ থেকে, ওই ঘোষিত দামের কমে পণ্য কেনা হয় না। এই ব্যবস্থার উদ্দেশ্য হল, চাষীর মুনাফা নিশ্চিত করা। বিশেষ করে অতি ফলনের মরশুমে। এটাকে সরকারের দিক থেকে এক ধরনের হস্তক্ষেপ বলা যেতে পারে। যাতে অতি ফলনের সময় দাম পড়ে গেলেও, সরকার নূন্যতম সহায়ক মূল্যে পণ্য কিনে ক্ষতির হাত থেকে চাষীকে বাঁচাতে পারে। আবার, একই সঙ্গে, ওই কেনা শস্য সরকার গণবন্টন ব্যবস্থার মাধ্যমে সরবরাহ করে।
কৃষি মন্ত্রকের কমিশন ফর এগ্রিকালচারাল কস্টস & প্রাইসেস-এর (সিএপিসি) পরামর্শের ভিত্তিতে, মরশুমের শুরুতেই, নির্বাচিত ফসলের জন্য নূন্যতম সহায়ক মূল্য ঘোষণা করে সরকার। বর্তমানে সিএপিসি ২৩টি কৃষিজাত পণ্যের ন্যূনতম সহায়ক মূল্য ঘোষণা করে। সেগিুলির মধ্যে রয়েছে ৭ রকমের শস্য (ধান, গম, ভুট্টা, জোয়ার, বাজরা, বার্লি, রাগি), ৫ ধরনের ডাল (ছোলা, তুর, মুগ, উড়াদ, মসুর), ৭ ধরনের তৈল বীজ (চিনে বাদাম, রেপসিড, সরষে, সোয়াবিন, তিল, সূর্যমুখী, নাইজার বীজ, সাফফ্লাওয়ার), ও ৪ ধরনের বানিজ্যিক পণ্য (নারকেলের ছোবড়া, আখ, তুলো, ও কাঁচা পাট)।
নূন্যতম সহায়ক মূল্য এমন ভাবে ঠিক করা হয় যাতে চাষী উৎপাদনের খরচ মিটিয়ে লাভ করতে পারে। ২০১৮-১৯-এর কেন্দ্রীয় বাজেট পেশ করার সময়, তৎকালীন অর্থমন্ত্রী অরুণ জেটলি ঘোষণা করেছিলেন যে, ন্যুনতম সহায়ক মূল্য হবে উৎপাদন খরচের ১.৫ গুণ।
উৎপাদন খরচ কত, তা স্থির করতে সিএপিসি যে ফরমুলাটি ব্যবহার করে তা হল: A2, A2+FL ও C2।
A2 হলো, বাস্তবে যে টাকা খরচ করা হয়েছে। A2+FL হল যে টাকা খরচ করা হয়েছে এবং পরিবারের সদস্যদের শ্রম, যার একটা অর্থ মূল্য আছে, কিন্তু বাস্তবে যা মজুরি হিসেবে দেওয়া হয়নি। আর C2 হল সামগ্রিক উৎপাদন খরচ। তার মধ্যে ধরা হয় A2+FL, জমির ভাড়া, জমির মূল্যের ওপর ও মূলধনের ওপর সুদ।
C2 হল সুপারিশ-করা ফর্মুলা, যেটি উৎপাদনের খরচের ওপর ৫০% মুনাফা নিশ্চিত করে। প্রফেসর স্বামীনাথনের সভাপতিত্বে, ন্যাশনাল কমিশন অফ ফারমার্স ওই ফরমুলাটি সুপারিশ করে। কিন্তু জেটলি ঘোষণা করেন যে. সরকার A2+FL ফরমুলাটি মেনে চলবে।
এফসিআই ও রাজ্য সংস্থার দ্বারা ক্রয়
নূন্যতম সহায়ক মূল্য ঠিক হয়ে গেলে, কেন্দ্রের ক্রেতা, খাদ্য ও গণবন্টন মন্ত্রকের অধীনে ফুড করপোরেশন অফ ইন্ডিয়া ও রাজ্যের সংস্থাগুলি, ওই দামে পণ্য কিনতে শুরু করে। বর্তমানে নূন্যতম সহায়ক মূল্যে কেনার ব্যবস্থা কেবল গম আর ধানের ক্ষেত্রেই চালু আছে।
কী পরিমাণ শস্য কেনা হবে, তা নির্ভর করে লক্ষ্যমাত্রার ওপর। আর সেই কারণে, পরিমাণটা বিভিন্ন রাজ্যে আলাদা হয়। এ ক্ষেত্রে পঞ্জাবের অবস্থান অন্য সব রাজ্য থেকে আলাদা।
ভারতে ধান উৎপাদনের ক্ষেত্রে পশ্চিমবঙ্গের পরেই পঞ্জাবের স্থান। দেশের ধান উৎপাদনের ১১.৫% হয় পাঞ্জাবে। এবং গমের ক্ষেত্রে, উত্তরপ্রদেশের পরেই আছে পঞ্জা্ব। দেশে গম উৎপাদনের ১৭.৯% আসে ওই রাজ্য থেকে। কিন্তু সরকারের কেনা ধানের ৬২% আর গমের ৩২.৬% আসে পঞ্জাব থেকে।
২০২০-২১ সালের রবি শস্যের মরসুমে, কেন্দ্রের গম কেনার ক্ষেত্রে, মধ্যপ্রদেশের অবদান ছিল ৩৩.২%।
নূন্যতম সহায়ক মূল্য কার্যকর করা ও সরকারের শস্য কেনার ক্ষেত্রে রাজ্যগুলির মধ্যে তারতম্য ঘটে। যেখানে নূন্যতম সহায়ক মূল্যে প্রচুর পরিমাণে ধান ও গম কেনে সরকার, সেখানে খোলা বাজারেও দাম ওই সহায়ক মূল্যের কাছাকাছি থাকে (যেমন, পঞ্জাব ও হরিয়ানায়)। কিন্তু যেখানে সরকার অল্প পরিমাণে কেনে বা কেনেই না, সেখানে বাজারে দাম নূন্যতম সহায়ক মূল্যের অনেক নীচে থাকে।
ফলে, নূন্যতম সহায়ক মূল্য ও সেই সঙ্গে সরকারি ক্রয় সাধারণত কৃষকদের সুবিধে করে দেয়। কারণ, বেসরকারি ক্রেতাদেরও সহায়ক মূল্যের কাছাকাছি দাম দিতে হয়।
ভয়ের কি কোনও যৌক্তিকতা আছে?
একটি নতুন আইন হল 'কৃষি পণ্য লেনদেন ও বাণিজ্য উন্নয়ন আইন ২০২০'। এই আইন এগ্রিকালচারাল প্রডিউস মার্কেট কমিটির (এপিএমসি) বাজারের বাইরেও বাজার স্থাপন করার অনুমতি দেয়। এর ফলে, শস্য কেনা-বেচার জন্য নতুন বাজার তৈরি হবে এবং সেখানে কৃষক ও ক্রেতাদের ওপর কোনও কর চাপাতে পারবে না রাজ্য। যেমনটা এখন করা হয় এপিএমসি মান্ডিগুলিতে।
বিক্ষোভরত চাষিদের আশঙ্কা যে, দু'টি বাজারে ভিন্ন কর ব্যবস্থা চালু হলে (এপিএমসি কর-যুক্ত, নতুন বাজার কর-মুক্ত), স্বাভাবিক ভাবেই কর-মুক্ত বাজার ব্যবসা দখল করে নেবে। এবং এপিএমসি বাজারে লেনদেন কমে যাওয়ার ফলে, সেখান থেকে কর বাবদ রাজ্যের যথেষ্ট আয় না হলে, হয়ত এপিএমসি ব্যবস্থাটাকেই তুলে দেওয়ার দিকে এগোবে রাজ্য।
গ্রামীণ অর্থনীতির ওপর একজন বিশেষজ্ঞ, সাংবাদিক পি সাইনাথ, ইন্ডিয়া টুডে-তে রাজদীপ সারদেশাইয়ের সঙ্গে এক সাক্ষাৎকারে বলেন যে, বিশেষ করে পঞ্জাব ও হরিয়ানাতে কৃষক বিক্ষোভ বেশ বড় আকার ধারণ করেছে। কারণ, তিনি বলেন, কৃষকরা আশঙ্কা করছেন যে, এই নতুন আইন, বর্তমান মান্ডি ব্যবস্থা ও রাজ্য দ্বারা ক্রয়ের নিশ্চয়তাকে খর্ব করবে। তাছাড়া, সরকারের সংঘাতপূর্ণ মনোভাব পরিস্থিতিকে আরও ঘোরাল করে তুলেছে। উনি আরও বলেন যে, "কেনার নিশ্চয়তা না থকলে, সহায়ক মূল্য বাড়ানোটা অর্থহীন হয়ে পড়ে।"
অন্যদিকে, নতুন কৃষি আইনের পক্ষে কথা বলেন কৃষি অর্থনীতিবিদ ও সিএসিপি-র প্রাক্তন সভাপতি অশোক গুলাটি। উনি মনে করেন, ভুল তথ্য পরিবেশন ও প্রচার চালানোর ক্ষেত্রে সরকারের ব্যর্থতা, এই বিক্ষোভের জন্ম দিয়েছে। মূল্যের স্থিতিশীলতা সম্পর্কে গুলাটি বলেন, "বাজারগুলিকে স্থিতিশীল করার প্রয়োজন আছে। এবং বেসরকারি পথেই তা সম্ভব।" পোল্ট্রি আর দুধ শিল্পের উদাহরণ দিয়ে গুলাটি বলেন যে, এই দু'টি ক্ষেত্রেই বৃদ্ধির হার শস্যের তুলনায় অনেক বেশি। এই উদাহরণ দিয়ে উনি বোঝাতে চান যে, চাষী ও নানান কোম্পানি এক সঙ্গে হলেই অস্থিরতা দেখা দেবে বা চাষীরা ক্ষতিগ্রস্ত হবেন, এমনটা নয়।
কিন্তু পঞ্জাব ও হরিয়ানায় এপিএমসি মান্ডিগুলি এখনও যথেষ্ট সক্রিয়। ওই মাণ্ডিগুলির ভবিষ্যৎ ও কোনও বিধিনিষেধের অনুপস্থিতিতে বড় কোম্পানিগুলির কার্যকলাপ সম্পর্কে ওই দুই রাজ্যের কৃষকদের আশঙ্কা দূর করার ব্যাপারে সরকার তেমন কোনও পদক্ষেপ নেয়নি। তাছাড়া, ধান আর গমের মত উচ্চ-ফলনশীল পণ্য কেনার ব্যাপারেও সরকার কোনও প্রতিশ্রুতি দেয়নি। অথচ, উত্তর ভারতের ব্যাপক অঞ্চলে এগুলিই প্রধান শস্য।
সহায়ক মূল্যে সরকার যদি শস্য কেনা বন্ধ করে দেয়, তা হলে গণবন্টন ব্যবস্থাও সঙ্কটে পড়তে পারে। জাতীয় খাদ্য নিরাপত্তা আইন ২০১৩ অনুযায়ী, জনসংখ্যার ৬৭% মানুষকে কম দামে খাদ্য শস্য (চাল, গম, বাজরা) দেওয়ার কথা সরকারের। ক্ষুধা সূচক সংক্রান্ত বিষয়ে ভারতের অবস্থান ভালো নয়। গ্লোবাল হাঙ্গার ইন্ডেক্স-এ, ১০৭টি দেশের মধ্যে ভারতের স্থান ৯৪। অথচ, ভারত একটি খাদ্য উদ্বৃত্ত দেশ।
কৃষকরা যে আশঙ্কা প্রকাশ করছেন, তার পরিপ্রেক্ষিতে মোদী জোর দিয়ে বলেছেন "ন্যুনতম সহায়ক মূল্য ব্যবস্থা" বহাল থাকবে এবং "সরকারি ক্রয় চলতে থাকবে"। নতুন কৃষি আইন চালু হওয়ার পর, প্রতিবাদ ঠেকাতে প্রশাসনের তরফে এ কথা ধারাবাহিক ভাবে বলা হয়েছে। কিন্তু কৃষকরা দাবি করছেন, সরকার সহায়ক মূল্য ও শস্য কেনার বিষয়টা আইনে নথিভুক্ত করুক।