ড. লি-মেঙ ইয়ান হলেন একজন চিনা ভাইরোলজিস্ট। সার্স-কভ-২ ভাইরাস চিনের উহানের ল্যাবরেটারিতে তৈরি করা হয়েছে, এই ষড়যন্ত্র-তত্ত্বকে সমর্থন করায় উনি সম্প্রতি খবরের শিরোনামে এসেছেন। পৃথিবীজুড়ে ওই ভাইরাস তিন কোটিরও বেশি মানুষকে প্রভাবিত করেছে। 'জেনেডো' নামের এক 'ওপেন সোর্স' বা সকলেই দেখতে পারেন এমন এক মুক্ত জার্নালে, ১৪ সে্প্টেম্বর ওনার একটি গবেষণা পত্র প্রকাশিত হয়। তাতে একজন 'হুইসিলব্লোয়ার'-এর (যিনি সকলকে কোনও একটি বিষয়ে সতর্ক করে দেন) ভূমিকা পালন করে বলেছেন, "সার্স-কভ-২ বাদুড়ের করোনাভাইরাস ব্যবহার করে গবেষণাগারে তৈরি একটি বস্তু হওয়াই স্বাভাবিক।"
ওই গবেষণা পত্রে ইয়ান ও তাঁর সহ লেখকরা দেখিয়েছেন কী ভাবে একটি সম্ভাব্য সিন্থেটিক বা কৃত্রিম পথে সার্স-কভ-২ ভাইরাস মানুষের শরীরে প্রবেশ করে। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে অবস্থিত একটি অলাভজনক সংস্থা 'রুল অফ ল ফাউন্ডেশন' ওই গবেষণার কাজকে সাহায্য করে এবং দাবি করে যে, বাদুড়ের শরীর থেকে পাওয়া করোনাভাইরাসকে ছ' মাসের মধ্যে বদলে ফেলা যায়।
ভাইরাসটি যে মানুষের তৈরি, তাঁর এই দা্বির পেছনে তিনটি কারণের কথা ইয়ান উল্লেখ করেছেন।
১) থার্ড মিলিটারি মেডিক্যাল ইউনিভারসিটি (চঙ্গকিং, চিন) ও রিসার্চ ইনস্টিটিউট ফর মেডিসিন ফর নানজিং কমান্ড (নানজিং, চিন) যে বাদুড়ের ভাইরাস আবিষ্কার করেছে তার সঙ্গে সার্স-কভ-২ ভাইরাসের এক সন্দেহজনক সাদৃশ্য আছে।
২) সার্স-কভ-২ ভাইরাসের স্পাইক প্রোটিনের মধ্যে যে রিসেপ্টার বাইন্ডিং মোটিফ (আরবিএম) বা মানুষের কোষের সঙ্গে জুড়ে যায় যে অংশটি, সেটির জিনে মডিফিকেশন বা বদল ঘটানো হয়েছে।
৩) সার্স-কভ-২ ভাইরাসের বৈশিষ্ট্য হল সেটির স্পাইক প্রোটিনে এক অনন্য ফুরিন-ক্লিভেজ আছে, যা অন্য করোনাভাইরাসে নেই।
এই তিনটে কারণের দুটিকে নস্যাৎ করা হয়েছে 'নেচার' জর্নালে প্রকাশিত গবেষণা পত্রে। ইয়ানের গবেষণায় সেগুলির উল্লেখও আছে, কিন্তু সেগুলি তেমন বিশ্বাসযোগ্য নয় বলে মন্তব্য করেছেন ইয়ান।
ইয়ান ছিলেন হংকং ইউনিভারসিটির স্কুল অফ পাবলিক হেল্থ-এর প্রাক্তন পোস্ট-ডক্টরাল ফেলো (ডক্টরেট করার পর যিনি গবেষণা করছিলেন)। তিনি অভিযোগ করেছেন যে, তাঁর গবেষণা থেকে পাওয়া সার্স-কভ-২ সংক্রান্ত তথ্য সম্পর্কে তাঁকে কথা বলার অনুমতি দেয়নি তাঁর ইউনিভারসিটি। উনি হংকং থেকে পালিয়ে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে চলে আসেন। জুলাই থেকে উনি এই ভাইরাসটি নিয়ে গবেষণা সংক্রান্ত বিষয়ে বিতর্ক চালিয়ে যাচ্ছেন। উনি এও বলেছেন যে, তাঁর প্রাণহানি ঘটতে পারে।
১৫ সে্প্টেম্বর, ইয়ান ফক্স নিউজে টাকার কার্লসন-এর শো-এ অংশ নেন। ফেসবুক ও ইনস্টাগ্র্যাম ওই ভিডিও ও তার স্নিপেট বা খুদে সংস্করণগুলিকে 'মিথ্যে' বলে চিহ্নিত করে। যে সব পোস্ট ভুল তথ্য ছড়ানর কাজে ব্যবহার করা হয়, সেগুলিকে বিশেষভাবে চিহ্নিত করা হয় সোশাল নেটওয়ার্কে।
১৫ সেপ্টেম্বর টুইটারও ইয়ানের প্রোফাইল বন্ধ করে দেয়।
আরও পড়ুন: অক্সফোর্ড-অ্যাস্ট্রাজেনেকা কোভিড টিকা ট্রায়াল আবার ভারতে চালু সিরামের
সার্স-কভ-২ সংক্রান্ত ইয়ানের দাবি
বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা বা হু, চিন সরকার এবং নিজের ইউনিভারসিটি সার্স-কভ-২ সংক্রান্ত তথ্য ধামাচাপা দেওয়ার চেষ্টা করেছে বলে অভিযোগ করেছেন ইয়ান। উনি এও বলেছেন যে, তাঁর প্রফেসার ও সিনিয়ররা তাঁকে ওই ভাইরাসটি নিয়ে কথা বলতে নিষেধ করেন। ইয়ান আরও বলেন যে, তিনি তাঁর উক্তির সমর্থনে প্রমাণ পেশ করবেন।
জুলাই ১১ ও ১৩, ফক্স নিউজ এই দু'দিন তাঁর সাক্ষাৎকার নেয়। ১৩ জুলাইয়ের সাক্ষাৎকারে ইয়ান বলেন, তিনি এথন বিপদের সম্মুখীন। হংকংয়ে থাকলে তাঁকে "নিখোঁজ করে দেওয়া হত, এমনকি মেরেও ফেলা হতে পারত"। ২৮ এপ্রিল উনি মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে পালিয়ে যান। ইয়ান দাবি করেন যে সার্স-কভ-২ যে অতিমারি সৃষ্টি করার ক্ষমতা রাখে, তা তিনি বুঝতে পেরে ছিলেন এবং সেই সম্ভাবনার কথা জানিয়ে ছিলেন তার সুপারভাইজার প্রফেসার লিও পুন লিট-ম্যানকে। কিন্তু তিনি তাঁকে চুপ করে থাকতে বলেন, তেমনটাই দাবি ইয়ানের।
আমেরিকাভয়েসনিউজ.কম-কে দেওয়া অন্য একটি সাক্ষাৎকারে ইয়ান বলেন যে, তাঁর গবেষণা থেকে উঠে আসা তথ্য উনি প্রফেসার পেইরিস মালিক-এর সঙ্গে শেয়ায় করেন। প্রফেসার মালিক হু-এর সঙ্গে কাজ করছিলেন ও পরে অবসর নেন।
জুলাই মাসেই হংকং ইউনিভারসিটি ইয়ানের অভিযোগগুলি উড়িয়ে দেয়। ওই ইউনিভারসিটি জানায় যে ডিসেম্বর ও জানুয়ারি মাসে ইয়ান সার্স-কভ-২ ভাইরাস নিয়ে গবেষণা করেননি। ইউনিভারসিটি অফ হংকং-এর কর্তাব্যক্তিদের সঙ্গে বুম যোগাযোগ করে, কিন্তু ইউনিভারসিটির কাছ থেকে কোনও প্রতিক্রিয়া পাওয়া যায়নি।
উহান শহরে সামুদ্রিক খাবারে্র একটি বাজারে ভাইরাসটি পাওয়া গেলেও, ওই ভাইরাস যে মানুষ থেকে মানুষে ছড়াতে পারে, সে কথা চিন হু কে জানায় ২০ জানুয়ারি।
তাঁর হংকং ইউনিভারসিটির সহকর্মীদের সঙ্গে লেখা দু'টি গবেষণা পত্র নেচার ও দ্য ল্যানসেট জার্নালে প্রকাশিত হয় মে ও জুন ২০২০ তে। নেচার-এ প্রকাশিত গবেষণা পত্রে নজর দেওয়া হয় হ্যামস্টার বা এক ধরনের বড় ইঁদুরের মধ্যে সার্স-কভ-২ কী ভাবে ছড়ায়, সেই বিষয়টির ওপর। এবং ল্যানসেট-এর গবেষণা পত্রে হাল্কা ও জোরাল ভাবে আক্রান্ত রোগীদের মধ্যে আরএনএ হ্রাসের ওপর আলোকপাত করা হয়।
১৩ জুলাই, ফক্স নিউজকে দেওয়া এক একান্ত সাক্ষাৎকারে ইয়ান জানান যে, তিনি মার্কিন সরকারের সঙ্গে যোগাযোগ রেখে চলেছেন। উনি এও বলেন যে, তিনি তাঁর গবেষণার সব বিষয়বস্তু মার্কিন সরকারের সঙ্গে শেয়ার করেছেন।
আরও পড়ুন: ভারতে কোভিড-১৯ পুনরায় সংক্রমণের নজির সীমিত: হু'র ভারতীয় প্রতিনিধি
১৫ সেপ্টেম্বর, সকলে দেখতে পারে (ওপেন অ্যাকসেস) এমন একটি সাইটে ইয়ান তাঁর গবেষণা পত্র প্রকাশ করেন। তাতে উনি প্রতিষ্ঠা করার চেষ্টা করেন যে সার্স-কভ-২ ভাইরাসটি মানুষের তৈরি আর সেই সঙ্গে দেখান কী ভাবে একটি কৃত্রিম পন্থার মাধ্যমে ভাইরাসটি মানুষের শরীরে প্রবেশ করে। ১৬ সেপ্টেম্বর উনি টাকার-এর শো তে অংশ নেন, যেখানে উনি নিজের গবেষণার ফলাফল নিয়ে আলোচনা করেন। তাঁকে যখন জিজ্ঞেস করা হয় ওই ভাইরাস সৃষ্টি করার পেছনে কী উদ্দেশ্য থাকতে পারে, ইয়ান সরাসরি জবাব না দিয়ে বলেন, উত্তরটা চিনের কমিউনিস্ট পার্টিই দিতে পারে।
ইয়ান একজন প্রশিক্ষণপ্রাপ্ত এমডি ও পিএইচডি। চিনের সেন্ট্রাল সাউথ ইউনিভারসিটির শিয়াংয়া মেডিক্যাল কলেজ থেকে এমডি ডিগ্রি পান। এবং পিএইচডি করেন চিনের সাদার্ন মেডিক্যাল ইউনিভারসিটি থেকে।
স্টিভ ব্যাননের সঙ্গে সম্পর্ক
'রুল অফ ল সোসাইটি' ও 'রুল অফ ল ফাউন্ডেশন' ইয়ানের গবেষণায় সাহায্য করে। ওয়াশিংটন ইউনিভারসিটির জীববিজ্ঞানী প্রফেসর কার্ল বার্গস্টর্ম ওই ফাউন্ডেশন ও স্টিভ ব্যাননের যোগাযোগের কথা টুইট করেন। ব্যানন হলেন ট্রাম্প সরকারের প্রাক্তন কৌশল নির্ধারক, যাঁর বিরুদ্ধে এখন জালিয়াতির মামলা চলছে। বার্গস্টর্ম ইয়ানের গবেষণাটিকে "বিচিত্র" আখ্যা দেন।
ওই অ-মুনাফার সংস্থাগুলি কখনও কোনও বৈজ্ঞানিক বা চিকিৎসা সংক্রান্ত কোনও গবেষণা পত্র ছাপেনি। নির্বাসিত চিনা ধনকুবের গুয়ো ওয়েংগুই ওই সংস্তাগুলির প্রতিষ্ঠাতা। সেগুলির উদ্দেশ্য হল "চিনের রাজনীতি, আইন, ব্যবসা ও আর্থিক ব্যবস্থার মধ্যে দুর্নীতি, প্রতিবন্ধকতা, বাধা, বেআইনি কাজ, নৃশংসতা, অকারণে কারাবাস, অতিমাত্রায় সাজা ও হয়রানির ছবিটা জনসমক্ষে তুলে ধরা।"
এই ধরনের বেশ কয়েকটি উদ্যোগের ক্ষেত্রে ব্যানন আর ওয়েংগুই হাত মেলান, বলেছে নিউ ইয়র্ক টাইমস। মেক্সিকো সীমান্তে দেওয়াল তোলার জন্য দাতাদের টাকা দিতে বাধ্য করার জন্য, ট্রাম্পের ওই কৌশল নির্ধারণকারী জালিয়াতির অভিযোগে গ্রেপ্তার হন।
সার্স-কভ-২ সংক্রান্ত বৈজ্ঞানিক তথ্য
ইয়ান অভিযোগ করেছেন যে, পিয়ার-রিভিউ করা জার্নালগুলি সেই সব গবেষণা পত্র ছাপছে না, যেগুলি দেখাচ্ছে যে ভাইরাসটি প্রাকৃতিক নয়। কিন্তু একাধিক বিজ্ঞানী একাধিকবার প্রমাণ করেছেন যে, ষড়যন্ত্রের তত্ত্বগুলি ভুল।
মার্চ ২০২০তে নেচার-এ প্রকাশিত একটি গবেষণা পত্রে বলা হয় যে, ল্যাবরেটারিতে ভাইরাসটি তৈরি করা কঠিন। বিশ্ব স্বস্থ্য সংস্থা ও মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের সেন্টারস অফ ডিজিজ কন্ট্রোল অ্যান্ড প্রিভেনশন নিশ্চিত করে যে সার্স-কভ-২ ভাইরাসটির উৎস প্রাকৃতিক।
বিজ্ঞানীরা আরও বলেন যে, বাদুড় থেকে পাওয়া দু'টি করোনাভাইরাসের মধ্যে সাদৃশ্য এবং সেগুলি যে চিনের একটি গবেষণাগারে পাওয়া গেছে, তা নেহাতই কাকতালীয়।
ইয়ান দাবি করেছেন যে, সার্স-কভ-২ ভাইরাসে ফুরিন ক্লিভেজ বলে একটি বৈশিষ্ট্য আছে, যা অন্য করোনাভাইরাসে নেই। একটি গবেষণায় কিন্তু বলছে মাউস হেপাটাইটিস করোনাভাইরাসেও ওই বৈশিষ্ট্য দেখা যায়। পাখির ইনফ্লুয়েনজা ভাইরাসেও তা আছে।
মুরগি থেকে ৫জি প্রযুক্তি, সার্স-কভ-২ ভাইরাস সম্পর্কে ষড়যন্ত্রের তত্ত্বগুলি চলছে সেই জানুয়ারি থেকে।
আরও পড়ুন: বিভ্রান্তিকরভাবে ছড়াল এপ্রিল মাসে ত্রিপুরায় এসমা আইন লাগু হওয়ার খবর