টেলিভিশন রেটিং পয়েন্টে (টিআরপি) কারচুপি নিয়ে গত সপ্তাহে অর্ণব গোস্বামীর নেতৃত্বাধীন রিপাবলিক টিভি ও ইন্ডিয়া টুডের মতো বড় সংবাদ চ্যানেল পরস্পরের দিকে অভিযোগের আঙ্গুল তুলেছে। মুম্বই পুলিশ রিপাবলিক টিভি এবং দুটি মারাঠি চ্যানেল ফকত মারাঠি ও বক্স সিনেমার বিরুদ্ধে অভিযোগ আনে যে তারা রেটিং-এ কারচুপি করছে। ব্রডকাস্ট অডিয়েন্স রিসার্চ কাউন্সিলের একটি সহযোগী সংস্থার করা অভিযোগের ভিত্তিতে মুম্বই পুলিশ পদক্ষেপ নেয়। ব্রডকাস্ট অডিয়েন্স রিসার্চ কাউন্সিল একটি রেটিং সংস্থা তথ্য এবং সম্প্রচার মন্ত্রকের তালিকাভুক্ত একটি সংস্থা।
অভিযোগটি প্রকাশ্যে আসার পরই মিডিয়া সম্বন্ধে ওয়াকিবহাল মহল জানিয়েছে, টিআরপি রেটিংয়ে কারচুপি নতুন কিছু নয়। অনেক দিন ধরেই এটি চলে আসছে।
টিআরপি ও তার গুরুত্ব
বিভিন্ন আর্থ-সামাজিক শ্রেণির মানুষ কোন টেলিভিশন চ্যানেলের অনুষ্ঠান কত ক্ষণ ধরে দেখছেন, তার পরিমাপকেই বলে টিআরপি। প্রতি সপ্তাহে বিএআরসি তাদের ওয়েবসাইটে এই রেটিং প্রকাশ করে।
টিআরপি-র মূল গুরুত্ব, এই রেটিং দেখেই বিজ্ঞাপনদাতারা কোনও চ্যানেলের প্রতি আকৃষ্ট হন। যেহেতু এই রেটিং দেখে বোঝা যায় যে মানুষ কোন সময়ে কোন চ্যানেলের অনুষ্ঠান বেশি দেখছেন, ফলে বিজ্ঞাপনদাতারাও সেই অনুযায়ী বিজ্ঞাপনের সময় কেনেন।
অন্য দিকে, চ্যানেলগুলিও টিআরপি রেটিং অনুসারে নিজেদের বিজ্ঞাপনের দাম স্থির করে। যে অনুষ্ঠানের টিআরপি রেটিং বেশি, তাতে বিজ্ঞাপন দেওয়ার জন্য চ্যানেলগুলি বেশি দাম ধার্য করে এবং এর মাধ্যমে তাদের লাভের পরিমাণও বৃদ্ধি পায়।
আরও পড়ুন: আরমেনিয়া-আজারবাইজান যুদ্ধ বলে টিভি৯ ভারতবর্ষ দেখাল ভিডিও গেমের দৃশ্য
টিআরপি হিসাব করা হয় কী ভাবে?
বিএআরসি বিভিন্ন বাড়িতে মিটার লাগায়, যা বার-ও-মিটার নামে পরিচিত। টেলিভিশনের অডিও আউটপুটের ওপর ভিত্তি করে এই মিটার তথ্য সংগ্রহ করে। এই মিটার বসানোর জন্য যে বাড়িগুলি বেছে নেওয়া হয়, সেগুলির আর্থ-সামাজিক ও ভৌগোলিক অবস্থান জানার জন্য সংস্থাটি 'ইন্ডিভিজুয়াল ইউজার আইডেন্টিফিকেশন' নামের পদ্ধতি ব্যবহার করে।
গোটা দেশে প্রায় ৪৫,০০০ বাড়িতে এই মিটার বসানো আছে। এই বাড়িগুলি মোট ১২টি শ্রেণিতে বিভক্ত। সব মিলিয়ে দেশের মোট ৮০ কোটি মানুষকে এই সমীক্ষার আওতায় আনা হয়।
যে বাড়িতে এই মিটার বসানো হয়, সেখানে টেলিভিশন সেট চালানোর জন্য একটি বিশেষ রিমোট দেওয়া যায়, যাতে দু'বছরের বেশি বয়সি পরিবারের সব সদস্যের জন্য আলাদা বোতাম থাকে। যিনি টিভি চালাবেন, তাঁকে তাঁর জন্য নির্দিষ্ট বোতামটি টিপতেই হবে।
এর পর বাড়িতে লাগানো মিটার টিভির শব্দ অনুসারে কোন অনুষ্ঠানটি চলছে, তা রেকর্ড করে নেয়, এবং সেই তথ্য পাঠিয়ে দেয়। রিমোটে কোন সদস্যের জন্য বরাদ্দ বোতামটি টেপা হয়েছে, তা থেকে বোঝা যায় অনুষ্ঠানটি কে দেখছেন।
টিআরপি-র হিসেবে কি কারচুপি করা সম্ভব?
যেহেতু মিটার বসানো আছে ৪৫,০০০-এর কাছাকাছি বাড়িতে, ফলে টিআরপি রেটিং কোনও অনুষ্ঠানের প্রকৃত জনপ্রিয়তার প্রতিফলন ঘটায় না।
তার ওপর, মিটার বসানো আছে, এমন বেশ কিছু বাড়িকে যদি কোনও সংবাদ চ্যানেল চিহ্নিত করতে পারে, তবে তারা বিভিন্ন অসদুপায় অবলম্বন করে সেই রেটিংকে প্রভাবিত করতে পারে (যেমন, কিছু টাকার বিনিময়ে তারা পরিবারের সদস্যদের একটি নির্দিষ্ট চ্যানেল দেখতে প্রভাবিত করতে পারে)।
সাংবাদিক অনিন্দ্য চক্রবর্তী গত সপ্তাহে কিছু টুইট করে ব্যাখ্যা করেন, কী ভাবে কোনও সংবাদ চ্যানেল টিআরপি রেটিংয়ে কারচুপি করতে পারে। তাঁর মতে, যে বাড়িতে মিটার বসানো আছে, কোনও সংবাদ চ্যানেল তাদের সঙ্গে যোগাযোগ করে একটা নতুন টিভি সেট কিনে দেওয়ার প্রস্তাব দিতে পারে, বিনিময়ে শুধু দীর্ঘ সময় তাদের চ্যানেলর অনুষ্ঠান চালিয়ে রাখতে হবে।
অনিন্দ্য তাঁর একটি টুইটে লিখেছেন, "মনে রাখবেন, ভারতে ইংরেজি সংবাদ চ্যানেল মাথাপিছু গড়ে দিনে মাত্র আট মিনিট দেখা হয়। এ বার ভাবুন, মাত্র চারটে মিটারওয়ালা বাড়িতে যদি প্রতি দিন মাত্র এক ঘণ্টাও কোনও একটি ইংরেজি খবরের চ্যানেল চলে, সার্বিক রেটিংয়ে তার কতখানি প্রবাব পড়বে। তার টিআরপি ছয়-সাত গুণ বেড়ে যাবে। অন্যদের তুলনায় তারা অনেক বেশি এগিয়ে থাকবে।"
বুম অনিন্দ্য চক্রবর্তীর সঙ্গে যোগাযোগ করলে তিনি বলেন যে এই ব্যাপারটা বেশ কয়েক দশক ধরে চলছে। বহু বার অভিযোগ জানানোর পরও বিএআরসি কোনও ব্যবস্থা গ্রহণ করেনি।
"আপনি মাত্র ৫০টা মিটারে কারচুপি করুন। মোট ২১০ জন দর্শক। তাঁদের বলুন, আপনার চ্যানেলটা দিনে পাঁচ ঘণ্টা করে চালিয়ে রাখতে। এর ফলে টিআরপি-তে কতখানি প্রভাব পড়বে, জানেন? এমনিতে যে চ্যানেলের দখলে আছে বাজারের মাত্র ২০ শতাংশ দর্শক, এইটুকু কারচুপিতে তার বাজারের দখল বেড়ে ৮০ শতাংশ হয়ে যাবে।"
এখন টিআরপি রেটিং নিয়ে যে বিতর্ক চলছে, সে প্রসঙ্গে বিএআরসি-র মুখপাত্র জানিয়েছেন, "বিএআরসি নিজেদের দায়িত্বে অচল আছে, অর্থাৎ 'ভারত কী দেখছে', সৎ এবং নিখুঁত ভাবে সেই হিসেব দেওয়ার কাজটা দায়িত্ব সহকারে করছে। বিএআরসি মুম্বই পুলিশের ভূমিকার প্রশংসা করছে, এবং প্রয়োজনে তাদের সঙ্গে সব রকম সহযোগিতা করতে প্রস্তুত।"
নিয়ন্ত্রক সংস্থাটি যেখানে এই কারচুপি রোধ করতে দৃশ্যত ব্যর্থ, বিজ্ঞাপনদাতারা এবং বিভিন্ন মিডিয়া এজেন্সি সংবাদ চ্যানেলে বিজ্ঞাপনের পিছনে খরচ করার কথাটি নতুন করে ভেবে দেখছেন।
বাজাজ অটো-র ম্যানেজিং ডিরেক্টর রাজীব বাজাজ সিএনবিসি টিভি১৮-কে বলছেন, তাঁর সংস্থা অভিযুক্ত সংবাদ চ্যানেলগুলিকে কালো তালিকাভুক্ত করেছে। "একটি শক্তপোক্ত ব্র্যান্ডের ওপর ভিত্তি করেই একটি শক্তপোক্ত ব্যবসা গড়ে তোলা যায়। কিন্তু, একটা মজবুত ব্যবসাকে সমাজের প্রতিও দায়িত্ব পালন করতে হবে। যারা সমাজকে বিষিয়ে দিচ্ছে বলে আমরা মনে করি, এমন কোনও কিছুর সঙ্গে আমাদের সংস্থা কখনও কোনও সংযোগ রাখে না।"
পার্লে জি-র সিনিয়র ক্যাটেগরি হেড কৃষ্ণরাও বুদ্ধ গত সপ্তাহে লাইভ মিন্টকেজানিয়েছিলেন, যে সব চ্যানেল বিদ্বেষমূলক কথা প্রচার করছে, তাঁর সংস্থা সেই চ্যানেলে বিজ্ঞাপন দেওয়া বন্ধ করে দেবে।
তিনি বলেন, "আমরা এমন একটি ব্যবস্থার খোঁজ করছি, যেখানে সব বিজ্ঞাপনদাতারা একজোট হয়ে সংবাদ চ্যানেলে বিজ্ঞাপনবাবদ খরচে রাশ টানতে পারবেন, যাতে সেই চ্যানেলগুলোর কাছে একটা স্পষ্ট বার্তা পৌঁছোয় যে তাদের অনুষ্ঠানের ভাষ্যে বদল আনাই তাদের পক্ষে মঙ্গলজনক।"
আরও পড়ুন: লাঠিচার্জের বিরুদ্ধে পুলিশ প্রতিবাদের সাজানো ভুয়ো ছবি ভাইরাল